ঢাকা ০৪:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo সাংবাদিক মঈন উদ্দিন এঁর পিতার মৃত্যুতে তরঙ্গ২৪.কম পরিবার গভীরভাবে শোকাহত Logo গ্যানিংগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে নানা আয়োজনে মহান বিজয় দিবস উদযাপন Logo মহান বিজয় দিবসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে বানিয়াচং মডেল প্রেসক্লাব Logo দেশবাসীকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ‘বানিয়াচং ইসলামি নাগরিক ফোরাম’ নেতৃবৃন্দ Logo নূরানী শিক্ষা বোর্ডে মেধা তালিকায় ২য় হয়েছে গ্যানিংগঞ্জ বাজার নূরানী মাদ্রাসার ছাত্রী মুনতাহা আক্তার Logo বানিয়াচংয়ে ১২কেজি গাঁজাসহ কুখ্যাত ৩ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার Logo বানিয়াচং শাহজালাল কে.জি স্কুল ২০২৩ বৃত্তি পরীক্ষায় ঈর্ষণীয় সাফল্য Logo চেয়ারম্যান মোঃ আনোয়ার হোসেন ডা. ইলিয়াছ একাডেমির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচিত Logo ৪০তম তাফসিরুল কোরআন মহা সম্মেলন সফল করায় আলহাজ্ব রেজাউল মোহিত খানের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ Logo ইফার সাবেক ফিল্ড অফিসার আব্দুল ওয়াদুদের মৃত্যুতে জেলা মউশিক কল্যাণ পরিষদ নেতৃবৃন্দের শোক

বানিয়াচঙ্গের ঐতিহাসিক গ্রাম মাকালকান্দিতে গণহত্যা

  • তরঙ্গ ২৪ ডেস্ক :
  • আপডেট সময় ০৩:৩৬:১১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ অগাস্ট ২০২০
  • ২৭১ বার পড়া হয়েছে

সাদাত হোসেন সাদাত : ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক মাকাল কান্দি গ্রাম হবিগঞ্জ মহুকুমার সিলেট জেলার অধীনে ছিল।ওই গ্রামটি তৎসময়ে এশিয়ার সবচেয়ে বড় গ্রাম যাহা বর্তমানে পৃথিবীর বড়গ্রাম হিসেবে স্বীকৃত বানিয়াচঙ্গ থানার আওতাধীন । বানিয়াচংয়ের উত্তর-পশ্চিম দিকে, উত্তর থেকে দক্ষিণদিক বরাবর ৭মাইল এবং পূর্ব-পশ্চিম দিকে ৫ মাইল ভূখণ্ডের একটি হাওর রয়েছে, যার আয়তন প্রায় ৩৫ বর্গমাইল। পনের শত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন অধ্যুষিত এই ভূখণ্ডের অভ্যন্তরেই মাকালকান্দি নামক গ্রামটির অবস্হান । এখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকার সুবাদে স্বাক্ষরতার হার ৩৫% এর কিছু বেশি ছিল। এই গ্রামের লোক চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং অধ্যাপক, পুলিশের স্পেশাল আই জি পি ও সাংবাদিক ছিলেন। অর্থনৈতিকভাবে গ্রামটি সমৃদ্ধ থাকায় এখানে একটিও খুঁড়ে ঘর ছিলনা। বানিয়াচং উপজেলার উত্তর- পূর্ব কোনজুরে হাওর বেষ্টিত দুর্গম এই মাকালকান্দি গ্রামটিকে নিরাপদ মনে করে তৎকালীন সময়ের স্হানীয় এমপি জনাব গোপাল কৃষ্ণ মহারত্নের পরিবারসহ অন্যান্য গ্রামের অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজন শরনার্থী হিসেবে এই গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল।
মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ গ্রামটি ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যতম টার্গেট। ১৯৭১ সালের ১৫ই আগস্ট হবিগঞ্জ সার্কিট হাউসে মহকুমা শান্তি কমিটির সঙ্গে এক সভা হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের। এ সভায় বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ থানার হিন্দু প্রধান এলাকায় আক্রমণের পরিকল্পনা করে তারা। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১৭ই আগষ্ট বানিয়াচং এ পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত কার্যকরি করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মেজর দুররানীর নেতৃত্বে পুলিশ অফিসার জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল স্হানীয় রাজাকার সৈয়দ ফজলুল হক মোতাওয়াল্লী, আব্দুল খালিক, আজমান মিয়া, ইব্রাহিম শেখ, কনর মিয়া, আতাউরসহ অনেকেই।

ছবি- বানিয়াচং মাকালকান্দি স্মৃতি সৌধ।

১৮ আগস্ট ভোরে ২৫ থেকে ৩০টি নৌকায় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে মাকালকান্দি গ্রামের মন্দিরে মনসা পূজা চলাকালীন সময়ে হামলা চালানো হয়। পেট্রোল ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় শত শত ঘর-বাড়ি। মহিলাদেরকেও ধর্ষণ করে নরপশুরা । একই পরিবারের এগারো জনসহ হত্যা করা হয় নারী, পুরুষ, শিশু মিলিয়ে প্রায় দুই শত। অনেকেই পানিতে পড়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে । মায়ের কোল থেকে শিশুকে নিয়ে গুলি করে হত্যার পর হাওরের পানিতে ফেলে দেওয়াসহ বেশ কয়েকজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকেও হত্যা করে নরপশুরা। ওই গ্রামের মিনতি রানীর কোল থেকে কেড়ে নিয়ে শিশুকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী
তিনি জানিয়েছেন, আমার কোল থেকে আমার সন্তানকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আমি হাতে পায়ে ধরেও আমার সন্তানকে বাঁচাতে পারিনি । ধ্বংসযজ্ঞের পর বাড়ি-ঘর ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় ডায়রিয়া, মহামারি ও অর্ধাহারে মারা যায় শিশু ও অনেক নারী-পুরুষ। শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এ গ্রামের বাড়িঘর থেকে ধান, স্বর্ণালঙ্কার থেকে শুরু করে ঘরের পিলার পর্যন্ত নিয়ে যায় লুণ্ঠনকারীরা।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহতদের প্রত্যেক পরিবারের সদস্যদের নগদ ১ হাজার টাকা এবং একটি করে সনদপত্র দেন। কিন্তু এরপর তারা আর কোনো সাহায্য সহায়তা পাননি সেই হতভাগা ব্যাক্তিরা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের সুদীর্ঘ ৩৬ বছর পর ২০০৭সালে গণহত্যা সংগঠিত এলাকায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আটাত্তর জন শহীদ ব্যক্তিদের নামের তালিকাসহ উপজেলা নির্বাহী অফিসার নুরে আলম সিদ্দিক একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন । বর্তমানে এখানে সরকারী ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছর ১৮ আগষ্ট “মাকালকান্দি গণহত্যা দিবস” পালন করা হয়। তৎকালীন সময়ে হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তারাও পাননি ন্যূনতম সম্মান বা বেঁচে থাকার কোনো সুযোগ-সুবিধা। নিহতদের স্বজনেরা নিরবে আশ্রু বিসর্জন করলেও এদের অনেকেই অর্ধাহারে-অনাহারে দিন যাপন করছেন। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এদের সাহায্যে কেউ এগিয়ে না আসলেও ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি , যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ওই গ্রামে হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় নিহত ও আহতদের নাম মুক্তিযুদ্ধাদের তালিকায় যেন স্থান পায়।

লেখক : সাদাত হোসেন সাদাত, সাবেক জেলা ছাত্রলীগ ( জাসদ) নেতা।

 

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

সাংবাদিক মঈন উদ্দিন এঁর পিতার মৃত্যুতে তরঙ্গ২৪.কম পরিবার গভীরভাবে শোকাহত

বানিয়াচঙ্গের ঐতিহাসিক গ্রাম মাকালকান্দিতে গণহত্যা

আপডেট সময় ০৩:৩৬:১১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ অগাস্ট ২০২০

সাদাত হোসেন সাদাত : ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক মাকাল কান্দি গ্রাম হবিগঞ্জ মহুকুমার সিলেট জেলার অধীনে ছিল।ওই গ্রামটি তৎসময়ে এশিয়ার সবচেয়ে বড় গ্রাম যাহা বর্তমানে পৃথিবীর বড়গ্রাম হিসেবে স্বীকৃত বানিয়াচঙ্গ থানার আওতাধীন । বানিয়াচংয়ের উত্তর-পশ্চিম দিকে, উত্তর থেকে দক্ষিণদিক বরাবর ৭মাইল এবং পূর্ব-পশ্চিম দিকে ৫ মাইল ভূখণ্ডের একটি হাওর রয়েছে, যার আয়তন প্রায় ৩৫ বর্গমাইল। পনের শত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন অধ্যুষিত এই ভূখণ্ডের অভ্যন্তরেই মাকালকান্দি নামক গ্রামটির অবস্হান । এখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকার সুবাদে স্বাক্ষরতার হার ৩৫% এর কিছু বেশি ছিল। এই গ্রামের লোক চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং অধ্যাপক, পুলিশের স্পেশাল আই জি পি ও সাংবাদিক ছিলেন। অর্থনৈতিকভাবে গ্রামটি সমৃদ্ধ থাকায় এখানে একটিও খুঁড়ে ঘর ছিলনা। বানিয়াচং উপজেলার উত্তর- পূর্ব কোনজুরে হাওর বেষ্টিত দুর্গম এই মাকালকান্দি গ্রামটিকে নিরাপদ মনে করে তৎকালীন সময়ের স্হানীয় এমপি জনাব গোপাল কৃষ্ণ মহারত্নের পরিবারসহ অন্যান্য গ্রামের অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজন শরনার্থী হিসেবে এই গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল।
মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ গ্রামটি ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যতম টার্গেট। ১৯৭১ সালের ১৫ই আগস্ট হবিগঞ্জ সার্কিট হাউসে মহকুমা শান্তি কমিটির সঙ্গে এক সভা হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের। এ সভায় বানিয়াচং, আজমিরীগঞ্জ থানার হিন্দু প্রধান এলাকায় আক্রমণের পরিকল্পনা করে তারা। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১৭ই আগষ্ট বানিয়াচং এ পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত কার্যকরি করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মেজর দুররানীর নেতৃত্বে পুলিশ অফিসার জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল স্হানীয় রাজাকার সৈয়দ ফজলুল হক মোতাওয়াল্লী, আব্দুল খালিক, আজমান মিয়া, ইব্রাহিম শেখ, কনর মিয়া, আতাউরসহ অনেকেই।

ছবি- বানিয়াচং মাকালকান্দি স্মৃতি সৌধ।

১৮ আগস্ট ভোরে ২৫ থেকে ৩০টি নৌকায় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে মাকালকান্দি গ্রামের মন্দিরে মনসা পূজা চলাকালীন সময়ে হামলা চালানো হয়। পেট্রোল ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় শত শত ঘর-বাড়ি। মহিলাদেরকেও ধর্ষণ করে নরপশুরা । একই পরিবারের এগারো জনসহ হত্যা করা হয় নারী, পুরুষ, শিশু মিলিয়ে প্রায় দুই শত। অনেকেই পানিতে পড়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে । মায়ের কোল থেকে শিশুকে নিয়ে গুলি করে হত্যার পর হাওরের পানিতে ফেলে দেওয়াসহ বেশ কয়েকজন অন্তঃসত্ত্বা নারীকেও হত্যা করে নরপশুরা। ওই গ্রামের মিনতি রানীর কোল থেকে কেড়ে নিয়ে শিশুকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী
তিনি জানিয়েছেন, আমার কোল থেকে আমার সন্তানকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আমি হাতে পায়ে ধরেও আমার সন্তানকে বাঁচাতে পারিনি । ধ্বংসযজ্ঞের পর বাড়ি-ঘর ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় ডায়রিয়া, মহামারি ও অর্ধাহারে মারা যায় শিশু ও অনেক নারী-পুরুষ। শিক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এ গ্রামের বাড়িঘর থেকে ধান, স্বর্ণালঙ্কার থেকে শুরু করে ঘরের পিলার পর্যন্ত নিয়ে যায় লুণ্ঠনকারীরা।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহতদের প্রত্যেক পরিবারের সদস্যদের নগদ ১ হাজার টাকা এবং একটি করে সনদপত্র দেন। কিন্তু এরপর তারা আর কোনো সাহায্য সহায়তা পাননি সেই হতভাগা ব্যাক্তিরা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের সুদীর্ঘ ৩৬ বছর পর ২০০৭সালে গণহত্যা সংগঠিত এলাকায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আটাত্তর জন শহীদ ব্যক্তিদের নামের তালিকাসহ উপজেলা নির্বাহী অফিসার নুরে আলম সিদ্দিক একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন । বর্তমানে এখানে সরকারী ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছর ১৮ আগষ্ট “মাকালকান্দি গণহত্যা দিবস” পালন করা হয়। তৎকালীন সময়ে হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তারাও পাননি ন্যূনতম সম্মান বা বেঁচে থাকার কোনো সুযোগ-সুবিধা। নিহতদের স্বজনেরা নিরবে আশ্রু বিসর্জন করলেও এদের অনেকেই অর্ধাহারে-অনাহারে দিন যাপন করছেন। সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এদের সাহায্যে কেউ এগিয়ে না আসলেও ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি , যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং ওই গ্রামে হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় নিহত ও আহতদের নাম মুক্তিযুদ্ধাদের তালিকায় যেন স্থান পায়।

লেখক : সাদাত হোসেন সাদাত, সাবেক জেলা ছাত্রলীগ ( জাসদ) নেতা।