শিব্বির আহমদ আরজু :
সাংবাদিকতা ও রাজনীতিতে অফুরন্ত মেধা ও সততার স্বাক্ষর রেখে গেছেন উপ মহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, বরেণ্য সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের অগ্নিপুরুষ সাবেক মন্ত্রী সিরাজুল হোসেন খান। আজ এ বর্ষিয়ান রাজনীতিবেদর ১৫তম মৃত্যু বার্ষিকী। ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ৮২ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। এ উপলক্ষে বানিয়াচংয়ে গ্রামের বাড়িতে পবিত্র কোরআন খতম, দুঃস্থদের মাঝে তবারক বিতরণ ও কবর যিয়ারত অনুষ্ঠিত হবে।
জন্ম : ১৯২৬ খ্রি. ১৭ জুলাই হবিগঞ্জের প্রাচীন গ্রাম বানিয়াচঙ্গের সাগর দীঘির পশ্চিম পাড়স্থ সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে (খান বাড়িতে ) জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবুল হোসেন ছিলেন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন কারাবরণকারি নেতা।
শিক্ষাজীবন : স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৩য় শ্রেণি পাস করে তৎকালীন লোকনাথ-রমন বিহারী ( বর্তমানে এল আর) হাইস্কুলে ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন সিরাজুল হোসেন খান। তিনি ১৯ ৪২ সালে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে। ১ম সাময়িকী পরিক্ষায় ক্লাসের ৭০জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি মার্ক পেয়ে সারা কলেজে আলোচনার ঝড় তুলেন।
তিনি ছোটবেলা থেকেই অদম্য মেধাবী ছিলেন এবং সমানতালে বাংলা-ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে পারতেন। ১৯৪৭ খ্রি. বিএ পাস করে এমএ তে আইনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।কিছুদিন পর সাবজেক্ট পরিবর্তন করে ইতিহাস নেন। পরবর্তীতে সাংবাদিকতায় স্কলারশীপ নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যান।
রাজনীতি: ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায়ই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। পরবর্তীতে বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
সিরাজুল হোসেন খানের মেধা এবং বাগ্নিতার জন্য হুজুর মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাকে অত্যন্ত স্নেহ এবং ভালবাসতেন। সিরাজুল হোসেন খানের পিতা আবুল হোসেন ও ন্যাপ -ভাসানী করতেন এবং বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন অগ্র সৈনিক হিসেবে মাওলানা আব্দুল হামিদ খানের সাথে বেশ সখ্যতা ছিল তাঁর। পরবর্তীতে এ সূত্র ধরেই ভাসানী এবং সিরাজুল হোসেন খানের মধ্যকার গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক তৈরী হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায়ই তৎকালীন ইংরেজি পত্রিকা পাকিস্তান অবজার্ভারের সহ সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন তিনি। ১৯৫০ খ্রি. এমএ পাস করে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগের পরিচালক হিসেবে যোগদেন সিরাজুল হোসেন খান।
গরীব-অসহায়ের জন্য যার চিত্ত ব্যাকুল তিনি কি সরকারি চাকুরি করে জৌলুস পূর্ণ জীবন অতিবাহিত করতে পারেন! তিনি স্বেচ্ছায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের চাকুরি ইস্তফা দিয়ে মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ( শ্রমিক আন্দোলন) জড়িয়ে পড়েন। সেই সাথে প্রভাবশালী ইংরেজি-বাংলা দৈনিকে ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে শোষক পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে নিরন্তর লিখতে থাকেন। ১৯৬৯ খ্রি. ইস্টার্ন নিউ এজেন্সি (এনা) প্রতিষ্ঠা করে এর সম্পাদক হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। এর আগে ইংরেজি দৈনিক ঢাকা টাইমসের সম্পাদক ছিলেন। তা ছাড়া তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং পরবর্তীতে এর সভাপতিসহ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব ও পালন করেন। ৬২ এর আয়ূব বিরোধী আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেল কাউন্সিলে সভাপতি হন মোহাম্মদ তোয়াহা এবং সাধারণ সম্পাদক হন সিরাজুল হোসেন খান। এ সময় দু’ দফায় ১৪ মাস কারাবরণ করেন তিনি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশ স্বাধীনের জন্য বহির্বিশ্বে লবিং করেন। সেই সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজে আত্ম নিয়োগ করেন। এ সময় পাকিস্তান সরকার এ দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে হত্যার মিশনে নেমে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা। এ তালিকার শীর্ষ পর্যায়ে ছিলেন সিরাজুল হোসেন খান। এ খবর পেয়ে ঢাকা থেকে বাইরোডে বানিয়াচঙ্গে গ্রামের বাড়িতে এসে মায়ের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে ভারতে চলে যান। সেখানে ট্রেনিং নিয়ে লন্ডনে গিয়ে সেখানকার ইংরেজি পত্রিকায় দেশের জন্য অবিরাম লেখতে থাকেন। সে সব লেখায় ফুটে ওঠতো পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরোচিত গণহত্যার বিষয়। দেশ স্বাধীন হলে তিনি বীরের বেশে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭৩ সালে জাগমুই গঠিত হলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং পরবর্তীতে গণতন্ত্রি পার্টির সভাপতি নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৮৫ সালে সিরাজুল হোসেন খান স্বৈরাচার সরকারকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনার শর্তে এরশাদ সরকারের মন্ত্রী সভায় যোগ দেন।
প্রথমেই তিনি ভূমি মন্ত্রীর দায়িত্বপান। এ দেশে পূর্ব থেকে জাল যার জলা তার নীতি ছিল না। জলা ছিল উপরি শ্রেণির লোকদের। তিনিই প্রথমে জাল যার জলা তার নীতি প্রচলন করেন। সারা জীবন মেহনতি মানুষদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম নির্যাতন ভোগ করেছেন দেশকে ভালবেসে। মন্ত্রী হয়েও তিনি সে ধাজ ধরে রেখেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তথ্য এবং মৎস্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও দক্ষতার সাথে পালন করেন। রাজনীতিতে সিরাজুল হোসেন খানের ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ ও বিএনপির সাবেক মহাসচিব এবং সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত আব্দুল মান্নান ভূইয়াসহ অসংখ্য জাতীয় রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯৭৩ খ্রি. বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন।
পরবর্তী ১৯৮৬ খ্রি. এ আসন থেকে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে এমপি হন। তিনিই জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, দূর্নীতি রুখে না দাঁড়ালে অর্থনীতির বিকাশ হবে না। তিনি মন্ত্রীর হওয়ার আগে যেমন ছিলেন পরেও অনুরূপ ছিলেন। তিনি ন্যায়-নীতিকে বক্ষে ধারণ করে মন্ত্রণালয় পরিচালনা করেছেন এবং পরবর্তীতে দূর্নীতির বিন্দুমাত্র অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি এ মহান মানুষটির বিপক্ষে। সিরাজুল হোসেন খানের শত্রুপক্ষ ও তাঁর সততাকে স্বীকার করে স্যালুট করতো।
তিনি ছিলেন সততার মূর্তপ্রতিক। ন্যায়-নীতির এক মহীরূহ। পরবর্তীতে ১৯৯৭ খ্রি.এরশাদ সাহেবের সাথে বনিবনা না হওয়ায় জাতীয় পার্টি থেকে পদত্যাগ করে বিএনপিতে যোগদেন। সেই যোগদান ও বেশিদিন সুখকর হয়নি। এর পর রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বাংলাদেশ এবং বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে প্রভাবশালী ইংরেজি এবং বাংলা দৈনিক গুলোতে পুনরায় কলাম লেখা শুরু করেন। ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ৮২ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারনে ইন্তেকাল করেন। তাঁর লেখা বই বিশ্ব রাজনীতির রূপরেখা ও ছেঁড়া কাপড় ও সেলাই সহ বেশ কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে। তাঁর স্ত্রী ছিলেন কবি নজরুল ইসলাম সরকারি কলেজের ( বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) প্রিন্সিপাল।
২ ছেলে ও ২ মেয়ে । জ্যেষ্ট ছেলে জাহেদ হোসেন খান বিশ্ব ব্যাংকের আরবান স্পেশালিস্ট ও ছোট ছেলে সাদাত হোসেন খান আমেরিকা প্রবাসী। মেয়ে রওনক জাহান ফারুক ব্যাংকক দূতাবাসের সাবেক কর্মকর্তা ও প্রফেসর ডা. রাফাত আরা খানম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। উপ মহাদেশের এ বরেণ্য রাজনীতিক ও সাংবাদিককে বানিয়াচঙ্গের সাগর দীঘির উত্তর পাড়স্থ পারিবারিক কবরস্থানে মা-বাবার কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।
লেখক : সম্পাদক, তরঙ্গ টোয়েন্টিফোর ডটকম।