মাওলানা শমশীর আহমদ :
প্রথমেই সুদ ও মুনাফার মধ্যে পার্থক্য বুজতে হবে।
মুনাফা শব্দের অর্থ লাভ। ব্যবসা বা শিল্পখাতে বা উৎপাদনশীল কোন খাতে বিনিয়োগকৃত অর্থের উপর একটি নির্দিষ্ট সময়ে অনিশ্চিত অনির্দিষ্ট অতিরিক্ত কিছু পাওয়া ।
আর আরবীতে সুদকে বলে রিবা এবং এর আভিধানিক অর্থ হলো বৃদ্ধি,অতিরিক্ত, প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি। ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন, পণ্য বা অর্থের বিনিময়ে প্রদেয় অতিরিক্ত পণ্য বা অর্থই হলো রিবা বা সুদ।
ইসলাম ধর্মে সুদ হারাম ও এটি একটি জগন্যতম অপরাধ। এখন প্রশ্ন হলো ইসলাম ধর্মে সুদ কেন হারাম? এর জবাব হলো পৃথিবীতে সকল মানুষই এক আদমের (পিতার) সন্তান, আর ইসলাম ধর্ম বলে প্রত্যেক মুসলমান একে অপরের পরস্পর ভাই ও বোন। আর আমরা মানবিক দৃষ্টিতেও দেখতে পাই ভাই ও বোনের দায়িত্ব হলো ভাই বিপদে পড়লে বোন সাধ্যনুযায়ী টাকা/শ্রম/ বুদ্ধি দিয়া সাহায্য করবে। পক্ষান্তরে যদি বোন বিপদে পড়ে তাহলে ভাইও বোনের জন্য তদ্রুপ করবে। বিষয়টা এমন নয় যে একজন বিপদে পড়লে অন্যজন মরার উপর খাড়ার ঘা / সুযোগ বুজে আর বিপদের উপর আর বিপদ চাপিয়ে দিবে। বরং তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা তার নৈতিক দায়িত্ব। আর আমরা হলাম সামাজিক জীব।আর ধনী- গরীব নিয়ে আমাদের সমাজ আর এটাও সর্বজন স্বীকৃত গরীব মানুষ যদি তার শ্রম না দেয় তাহলে ধনীর টেবিলে এত সহজে ভাত উঠবে না এবং পৃথিবীর সভ্যতার চাকাও ঘুরবেনা ।তাই’ত রাসুল (সঃ) বলছেন, শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার প্রাপ্য মুজুরি দিয়ে দাও। আর সমাজে বসাবাস করতে গেলে ধনী-গরীব সবারই অর্থ প্রয়োজন হয়। তবে ধনীদের তুলনায় গরীবের অর্থের অভাবটা একটু বেশিই হয়ে থাকে, তাই গরীব লোকেরা বিভিন্ন সময়ে বিপদে পতিত হলে ধনীর দোয়ারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে থাকে।
সুদকে আল্লাহ এ কারণেই হারাম করেছেন, যেহেতু এর মাধ্যমে অভাবীদের অভাবকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানো হয়। একজন গরীব লোকের বিপদের সময় সাহায্যের পরিববর্তে উল্টা অধিকহারে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়। এছাড়াও সমাজে সুদের প্রচলনের কারণে পারস্পরিক সুসম্পর্ক নষ্ট হয়। বিশৃংখলা, মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি, খুন-খারাবি ব্যাপকহারে সংঘটিত হয়। সুদের প্রচলনের কারণে সমাজে মহাজনেরা কাজ-কর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য সব ছেড়ে দিয়ে তারা সুদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও সুদের রয়েছে আরো অনেক ক্ষতিকারক দিক।
এখন প্রশ্ন হলো, একজন গরীব মানুষের বিপদের সময় সামর্থবান ব্যক্তির সাহায্যের হাত বাড়ানো কি মানবিক দায়িত্ব না?
নাকি তা বিপদের সময় সাহায্যের পরিবর্তে মরার উপর খাড়ার ঘা দিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করা ?
এটা এমন হয়ে গেল যেন বিপদগ্রস্থ মানুষকে গলায় ছুরি ধরে নিজের স্বার্থ আদায় করা।
আর সুদ হারাম হওয়ার এর অন্যতম একটি কারণ হলো সুদের মাধ্যমে একজন সম্পদের পাহাড় গড়ে, অপরজন মাটির নিচে তলিয়ে যায় এবং অন্যায়ভাবে গরীবের সম্পদ আত্মসাৎ করা হয়।
যেই সমাজে সু্দের প্রবণতা বেড়ে যায় সেই সমাজে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা- সহমর্মিতা পেছনের দরজা দিয়া পালায়। পবিত্র কোরআন ও হাদিস দ্বারা সুদ হারাম একথা প্রমাণিত এবং এর শাস্তি সম্পর্কে বর্ণিত আছে।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে সূরা-বাকারা-২৭৬ নং আয়াতে আল্লাহ-পাক বলেন-” এবং তিনি ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করছেন।
এবং হাদিসে এসেছে-প্রখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বলেন, রাসূল (সা:) বলেছেন,” তোমাদের মধ্যে যারা সুদ খায়, সুদ দেয়, সুদের হিসাব লিখে এবং সুদের সাক্ষ্য দেয় তাদের উপর আল্লাহর লা’নত এবং এ অপরাধের ক্ষেত্রে সবাই সমান।( সহীহ বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী)।
অপর হাদিসে হযরত আবু হুরায়রা ( রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেন, সুদের গুনাহ সত্তর প্রকার, তার মধ্যে সবচেয়ে কম ভয়ঙ্করটি হলো একজন লোক তার আপন মায়ের সাথে ব্যভিচারের সমান ( ইবনে মাজাহ, আল বাইহাকি)।যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতের দিন দন্ডায়মান হবে, যেভাবে দন্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি, যাকে শয়তান আছর করে মোহবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলেছে: ক্রয়-বিক্রয় তো সুদ নেয়ার মতই। অথচ আল্লাহ তা’আলা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। অত:পর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপর আল্লাহর উপর নির্ভশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তারাই জাহান্নামে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। আল্লাহপাক সুদকে নিশ্চহ্ন করেন এবং দান/খায়রাতকে বর্ধিত করবেন। আল্লাহ পছন্দ করেন না কোন অবিশ্বাসী পাপীকে।” (সূরা বাকারাহ: ২৭৫-২৭৬)
যারা সুদ খেয়েছে তাদের তাওবা করে তা থেকে বিরত থাকতে আল্লাহপাক নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে
“হে ইমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যে সমস্ত আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা ইমানদার হয়ে থাক। অত:পর যদি তোমরা পরিত্যাগ না কর, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও। কিন্তু যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমরা নিজের মূলধন পেয়ে যাবে। তোমরা কারও প্রতি অত্যাচার করো না এবং কেউ তোমাদের প্রতি অত্যাচার করবে না।” (সূরা বাকারাহ: ২৭৮-২৭৯)
সুদী ব্যাংকে চাকরী করাও হারাম। যারা সুদ খায় তাদের জায়গা জাহান্নাম। তাছাড়া রাসূল (স:) সুদের সম্পৃক্ত চার প্রকারের লোককে অভিসম্পাত করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবেনে মাসউদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
ﻟَﻌَﻦَ ﺭَﺳُﻮﻝُ ﺍﻟﻠَّﻪِ – ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ – ﺁﻛِﻞَ ﺍﻟﺮِّﺑَﺎ ﻭَﻣُﻮﻛِﻠَﻪُ ﻭَﺷَﺎﻫِﺪَﻩُ ﻭَﻛَﺎﺗِﺒَﻪُ .
“রাসূল (স:) সুদগ্রহীতাকে, সুদদাতাকে, সাক্ষীদাতাকে এবং লেখককে অভিসম্পাত করেছেন” ( আহমদ, তিরমিযী ও ইবনে মাযাহ)
উপরোক্ত হাদিস মতে সুদী ব্যাংকে চাকরী করা হারাম।
আল্লাহ আমাদেরকে সত্য মেনে নেয়ার তাওফিক দিন-আমীন।
লেখক : আলেম ও মাদ্রাসা শিক্ষক, বানিয়াচং, হবিগঞ্জ।