ঢাকা ০৬:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৯ আশ্বিন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo বানিয়াচংয়ে স্কুল ছাত্রীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার Logo এমপি মজিদ খানের মধ্যস্থতায় বানিয়াচং সৈদারটুলা ছান্দের ২ গ্রুপের দ্বন্দ্ব নিরসন Logo মিশর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান পাওয়ায় মুফতি হাফিজুল হককে সংবর্ধনা প্রদান Logo আজমিরীগঞ্জে নিত্যপণ্যের মূল্য চড়া: ক্রেতাদের নাভিশ্বাস Logo একজন কর্মবীর সফল এমপি আব্দুল মজিদ খান Logo বানিয়াচংয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদ্মাসন সিংহ’কে বিদায় সংবর্ধনা Logo জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী মনজুর চৌধুরী Logo বানিয়াচংয়ে ইফা শিক্ষকদের নিয়ে ক্লাস্টার ট্রেনিং অনুষ্ঠিত Logo আজমিরীগঞ্জে পুলিশের অভিযানে ২০লিটার চোলাই মদ জব্দ : আটক-১ Logo প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) হলেন গোটা জাতির জন্য উত্তম আদর্শ

শিক্ষাব্রতী শওকত আলী স্যার

  • তরঙ্গ ২৪ ডেস্ক :
  • আপডেট সময় ০১:৪৪:২৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০
  • ৯৯ বার পড়া হয়েছে
মোঃ হাফিজুর রহমান : ‘শিক্ষাব্রতী শওকতআলী’ বইটি জনাব শওকত আলী স্যারের কর্ম–সাধনার পঞ্চাশপূর্তি স্মারক উপলক্ষে প্রকাশিত। বইটি সম্পাদনা করেছেন অপূর্ব শর্মা ও স্যারের বড় মেয়ে মুনিরা পারভীন। স্যার বইটি আমার জন্য লোক মারফত সূদুর সিলেটে থেকে সৌজন্য কপি হিসেবে পাঠিয়েছেন। এতেই প্রমাণিত আমি স্যারের একজন অত্যন্ত মায়ার ছাত্র। স্যার আমার হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। আমরা যখন ১৯৭৯ সালে নবম শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমরা স্যারকে পেয়েছি। স্যারের ক্লাস অত্যন্ত ভালো লাগত। স্যারের বাচনভঙ্গি ও অঙ্গ ভঙ্গিও ছিল দারুণ। স্যারের ১০০০ হাজারেরও বেশি কবিতা মুখস্ত ছিল। আমাদের প্রায় প্রত্যেকটি ক্লাসে ১/২টি কবিতা শ্রুতিমধুর ভাষায় তিনি আবৃত্তি করতেন। বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকদের ইতিহাস, জীবনবৃত্তান্ত, ঘটনা ইত্যাদি আলোচনা করতেন। স্যারের ক্লাসে কবি সাহিত্যিকদের যে সব ঘটনা শুনতাম, সেগুলো আমি আমার মাদরাসার বাংলা ক্লাসে প্রায়ই আলোচনা করি। স্যারের ক্লাসে বলা উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনার উল্লেখ করি। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন এসএসসি পরীক্ষা দেন, তখন ইতিহাসের একটি প্রশ্ন আসল, সম্রাট আকবর সম্পর্কে যাহা যান লিখ? তখন প্রতি প্রশ্নে ১০ নম্বর থাকত। ১০টি প্রশ্নের উত্তর করতে হতো। মোট নম্বর থাকতো ১০০। কবিগুরু উক্ত প্রশ্নটির উত্তর লিখতে শুরু করলেন। এই দিনের সমস্ত খাতায়ই তিনি সম্রাট আকবর সম্পর্কে লিখলেন। পরের দিন তিনি পরীক্ষা হলে আসলেন। পরের দিনের খাতায় লিখলেন, আগের দিনের পরের অংশ। পরের দিনের সমস্ত খাতায়ও তিনি সম্রাট আকবর সম্পর্কেই লিখলেন। এর পরের বাকি সব দিনের পরীক্ষাগুলোতেই তিনি সম্রাট আকবর সম্পর্কে লিখেছিলেন। কবিগুরু পরীক্ষাহলে সম্রাট আকবর সম্পর্কে যা লিখেছিলেন, সেগুলো দিয়ে নাকি সম্রাট আকবর সম্পর্কে একটি বই হয়েছিল। তখনই কবিগুরু কবি হিসেবে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ কবিগুরু ১০ম শ্রেণিতে থাকতেই উনার বনফুল কাব্যগ্রন্হ প্রকাশিত হয়েছিল। পাঠক একটি প্রশ্নে নম্বর ১০। পরীক্ষক যদি উনাকে ১০ নম্বরই দিয়ে দেন, তারপরও তো ইতিহাস পরীক্ষায় পাস করতে পারবেন না। আর অন্য বিষয়ের দিনও তিনি ইতিহাসের পরীক্ষা দিয়েছেন। কাজেই তিনি পরিক্ষায় পাস করার কল্পনাও করতে পারবেন না। এরপর থেকে নাকি নিয়ম করা হয়েছে, প্রশ্নে যাহা জান লিখতে নাই, লিখে হবে সংক্ষেপে লিখ। পরে নাকি বোর্ডের সদস্যগণ কবিগুরুর জ্ঞানের তীক্ষ্ণতা দেখে তাঁকে তখনকার এসএসসি অনারারী পাস ঘোষণা করেছিলেন।
ছবি- লেখক : হাফিজুর রহমান।
স্যার আমাকে স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। স্যারের অনুপ্রেরণায় স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিতর্ক ও কবিতা আবৃত্তিতে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। আমরা ১৯৮১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। কাজেই ১৯৮১ সালে আমরা স্কুল থেকে বিদায় নিয়ে যাই। এ সালে স্যারও সম্ভবত আমাদের স্কুল থেকে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান। এর পর থেকে স্যারের সাথে দীর্ঘ বৎসর যাবৎ দেখা হয় না। একদিন হঠাৎ করে দেখি স্যার বানিয়াচং বড় বাজারে একটি রাস্তার পাশে দাঁড়ানো। স্যারকে দেখা মাত্রই আমি স্যারের কাছে গেলাম। সম্ভবত বাজারেই আমি স্যারকে সালাম ও কদমবুসি করলাম। কারণ ইহা আমার পৈত্রিক শিক্ষা। স্যারকে বললাম, স্যার আমার বাসা আদমখানি, এখান থেকে ১০ মিনিটের রাস্তা। স্যার আপনি আমার বাসায় চলুন। স্যার বললেন, যাব একটি শর্তে। শুধু তোমার বাসায় চা খাব। আমি বললাম, ঠিক আছে স্যার। স্যার আমার বাসায় আসলেন। আমার ওয়াইফ সাহানা আক্তার খানমও স্যারকে সালাম ও কদমবুসি করলেন। আমরা স্যারকে দুপুরের খাবার খাওয়াইতে অনুরোধ করলাম। কিন্তু স্যার রাজি হলেন না। স্যারকে নাস্তা দিলাম। আমার ওয়াইফ স্যারকে বড় কাপে ভালো করে দুধের চা করে দিলেন। স্যার খুব খুশি হলেন। স্যার একদিন আমাকে বলেছিলেন, তোমার বউয়ের চায়ের কথা ভুলি নাই। আমার গফটের বাংলা প্রিয় স্যারকে বাসায় আনতে পেরে আমিও খুবই গর্বিত হলাম। ইহা প্রায় ১৫ বছর আগের ঘটনা। এক/দুই বছর আগের আর একটি ঘটনা। আমাকে দেখার জন্য একদিন স্যার আমার মাদরাসায় গেলেন। আমার তখন ক্লাস বিরতি ছিল। তাই আমি মাদরাসার পাশের রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম চা খেতে। মাদরাসার একজন অফিস সহায়ক আমার কাছে গিয়ে বললেন, স্যার! আপনার একজন ইয়ং বুড়ো স্যার আসছেন আপনাকে দেখতে। স্যারের বর্তমান বয়স প্রায় ৮০ বৎসর। আমি সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলাম শ্রদ্ধেয় শওকত স্যারই হবেন। গিয়ে দেখলাম আমাদের অধ্যক্ষ জনাব মাওলানা আবদাল খানের কাছে স্যার বসা। স্যারকে সালাম করার পর কদমবুসি করতে চাইলাম। স্যার কদমবুসি করতে দিলেন না, স্যারের বুকে টেনে নিলেন। মোবাইল–ফেইসবুক যুগ আসার পর মোবাইল ও ফেইসবুকের মাধ্যমেও স্যারের সাথে মধ্যে মধ্যে যোগাযোগ হয়। আমার ফেইসবুকের লেখাতে স্যার মধ্যে মধ্যে লাইক দিয়ে থাকেন এবং উৎসাহমূলক কমেন্ট করে থাকেন। স্যারের স্মৃতিকথা ফটোসহ দিন-তারিখ উল্লেখ করে ফেইসবুকে প্রেরণ করে থাকেন। আশ্চর্য হই স্যার নিজের স্মৃতিকথাগুলো, স্মৃতিগুলোর ফটো, দিন–তারিখসহ সংরক্ষণ করায়। আমিও স্যারের এগুলোতে প্রায়ই লাইক–কমেন্ট দিয়ে থাকি।
স্যারের গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং এর যাত্রাপাশা মহল্লায়। পিতার নাম জনাব মুনশি মোঃ সানাউল্লাহ। তিনি ১৯৫৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মাতার নাম : জনাবা আয়েশা খাতুন। তিনি ১৯৫৪ সালে ইন্তেকাল করেন। বড় ভাইয়ের নাম : জনাব প্রফেসর মোহাম্মদ আলী। তিনি ১৯৫০ সালে দর্শন শাস্ত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্হান অধিকার করেছিলেন। তিনি সিলেট এমসি কলেজের দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। তিনি চকবোর্ডে ডান ও বাম হাত দিয়ে সমান তালে লিখে একই সময়ে একই সরল রেখায় মিলাতে পারতেন। তিনি ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে ইন্সপেক্টর অব কলেজের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। তিনি হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। তিনি হবিগঞ্জ মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ছিলেন। বর্তমানে কলেজটি সরকারি। তার কণ্যাদের মধ্যে, প্রফেসর জনাবা জাহান আরা খাতুন, হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের অবসর প্রাপ্ত অধ্যক্ষ, প্রফেসর জনাবা শাহনাজ পারভীন, বৃন্দাবন সরকারি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল।
শওকত আলী স্যারের স্ত্রীর নাম :জনাবা সাহানা সুলতানা শেলী। তার একমাত্র বোনের নাম : মরিয়ম খাতুন। তিনি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। তিনি ১৯৩৪ সালে সুন্দর হাতের লেখায় আসাম প্রদেশের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন।
শওকত স্যারের দুই মেয়ে ও এক ছেলে।
বড় মেয়ে মুনিরা পারভীন। তিনি যুক্তরাজ্যে চ্যানেল এস এর সংবাদ পাঠিকা এবং একজন খ্যাতনামা আবৃত্তিকার। তিনি ১৯৯৮ সালে জাতীয় শিশু সপ্তাহ প্রতিযোগিতায় সুন্দর হাতের লেখায় দ্বিতীয় স্হান অধিকার করেছিলেন। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে রৌপ্য পদক গ্রহণ করেছিলেন। স্যারের দ্বিতীয় মেয়ের নাম : নাদিরা পারভীন চমন এবং ছেলের নাম : তারেক ইকবাল দীপ।
স্যার প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন রায়ের পাড়া প্রাইমারি স্কুল থেকে। মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এল আর হাইস্কুল, নবম শ্রেণিতে উঠে সিলেট চলে যান এবং সিলেট সরকারি পাইলট হাইস্কুলে ভর্তি হন। তিনি ১৯৬২ সালে উক্ত স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এর পর এমসি কলেজ থেকে আইএ এবং বিএ পাস করেন (১৯৬৬ সাল)। ১৮৭৪ সালে কুমিল্লা টিচার্স ট্রেইনিং কলেজ থেকে বিএড পাস করেন। ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেইনিং কলেজ থেকে এমএ ইন এডুকেশন পাস করেন। তিনি বহু ভাষাবিদ ছিলেন। তিনি ইংরেজি, উর্দু, আরবি এবং ফারসি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।
শওকত স্যার চট্টগ্রামের রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনি হাইস্কুল থেকে শিক্ষক হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে সরকারি কর্ম কমিশনের মাধ্যমে তিনি সরকারি হাইস্কুলে চাকুরিতে যোগদান করেন। সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে তিনি ২৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন, সুনামগঞ্জ পিটিআইয়ের সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদ থেকে ২০০৩ সালে। সিলেটের সীমান্তিক আইডিয়াল টিচার্স ট্রেইনিং কলেজের সহকারি অধ্যাপক পদ থেকে তিনি শিক্ষকতা জীবনের পুরোপুরিভাবে সমাপ্তি ঘটান। তিনি ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই শিক্ষকতা জীবনের ৫০’বছর অর্থাৎ অর্ধ শত বছর পূর্ণ করেন। তার দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর কর্ম সাধনার পূর্তির স্মারক হিসেবেই ‘শিক্ষাব্রতি শওকতআলী’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটিতে ২৯ জন লেখক–লেখিকার লেখা স্হান পেয়েছে।
প্রবাদে আছে, ‘মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে বয়সের মধ্যে নয়।’
কবির ভাষায়,
‘পিতা গড়ে শরীর শিক্ষক গড়ে মন
পিতা বড়ো না শিক্ষক বড়ো বলবে কোনজন।’
–কবি গোলাম মোস্তফা
পরিশেষে আমি আমার প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় স্যার জবাব শওকত আলী স্যারের মহান আল্লাহর নিকট দীর্ঘ জীবন ও সুস্বাস্থ্য কামনা করে আমার এ লেখা এখানেই শেষ করছি।
লেখিত : মোঃ হাফিজুর রহমান চৌধুরী, সিনিয়র শিক্ষক, বানিয়াচং সিনিয়র ফাযিল (আলিয়া) মাদরাসা
তথ্যসূত্র : কিছু আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এবং কিছু ‘শিক্ষাব্রতি শওকত আলী’ গ্রন্থ থেকে
লেখক : সহকারি শিক্ষক, সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা, বানিয়াচং।
ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

বানিয়াচংয়ে স্কুল ছাত্রীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার

শিক্ষাব্রতী শওকত আলী স্যার

আপডেট সময় ০১:৪৪:২৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০
মোঃ হাফিজুর রহমান : ‘শিক্ষাব্রতী শওকতআলী’ বইটি জনাব শওকত আলী স্যারের কর্ম–সাধনার পঞ্চাশপূর্তি স্মারক উপলক্ষে প্রকাশিত। বইটি সম্পাদনা করেছেন অপূর্ব শর্মা ও স্যারের বড় মেয়ে মুনিরা পারভীন। স্যার বইটি আমার জন্য লোক মারফত সূদুর সিলেটে থেকে সৌজন্য কপি হিসেবে পাঠিয়েছেন। এতেই প্রমাণিত আমি স্যারের একজন অত্যন্ত মায়ার ছাত্র। স্যার আমার হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। আমরা যখন ১৯৭৯ সালে নবম শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমরা স্যারকে পেয়েছি। স্যারের ক্লাস অত্যন্ত ভালো লাগত। স্যারের বাচনভঙ্গি ও অঙ্গ ভঙ্গিও ছিল দারুণ। স্যারের ১০০০ হাজারেরও বেশি কবিতা মুখস্ত ছিল। আমাদের প্রায় প্রত্যেকটি ক্লাসে ১/২টি কবিতা শ্রুতিমধুর ভাষায় তিনি আবৃত্তি করতেন। বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকদের ইতিহাস, জীবনবৃত্তান্ত, ঘটনা ইত্যাদি আলোচনা করতেন। স্যারের ক্লাসে কবি সাহিত্যিকদের যে সব ঘটনা শুনতাম, সেগুলো আমি আমার মাদরাসার বাংলা ক্লাসে প্রায়ই আলোচনা করি। স্যারের ক্লাসে বলা উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনার উল্লেখ করি। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন এসএসসি পরীক্ষা দেন, তখন ইতিহাসের একটি প্রশ্ন আসল, সম্রাট আকবর সম্পর্কে যাহা যান লিখ? তখন প্রতি প্রশ্নে ১০ নম্বর থাকত। ১০টি প্রশ্নের উত্তর করতে হতো। মোট নম্বর থাকতো ১০০। কবিগুরু উক্ত প্রশ্নটির উত্তর লিখতে শুরু করলেন। এই দিনের সমস্ত খাতায়ই তিনি সম্রাট আকবর সম্পর্কে লিখলেন। পরের দিন তিনি পরীক্ষা হলে আসলেন। পরের দিনের খাতায় লিখলেন, আগের দিনের পরের অংশ। পরের দিনের সমস্ত খাতায়ও তিনি সম্রাট আকবর সম্পর্কেই লিখলেন। এর পরের বাকি সব দিনের পরীক্ষাগুলোতেই তিনি সম্রাট আকবর সম্পর্কে লিখেছিলেন। কবিগুরু পরীক্ষাহলে সম্রাট আকবর সম্পর্কে যা লিখেছিলেন, সেগুলো দিয়ে নাকি সম্রাট আকবর সম্পর্কে একটি বই হয়েছিল। তখনই কবিগুরু কবি হিসেবে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ কবিগুরু ১০ম শ্রেণিতে থাকতেই উনার বনফুল কাব্যগ্রন্হ প্রকাশিত হয়েছিল। পাঠক একটি প্রশ্নে নম্বর ১০। পরীক্ষক যদি উনাকে ১০ নম্বরই দিয়ে দেন, তারপরও তো ইতিহাস পরীক্ষায় পাস করতে পারবেন না। আর অন্য বিষয়ের দিনও তিনি ইতিহাসের পরীক্ষা দিয়েছেন। কাজেই তিনি পরিক্ষায় পাস করার কল্পনাও করতে পারবেন না। এরপর থেকে নাকি নিয়ম করা হয়েছে, প্রশ্নে যাহা জান লিখতে নাই, লিখে হবে সংক্ষেপে লিখ। পরে নাকি বোর্ডের সদস্যগণ কবিগুরুর জ্ঞানের তীক্ষ্ণতা দেখে তাঁকে তখনকার এসএসসি অনারারী পাস ঘোষণা করেছিলেন।
ছবি- লেখক : হাফিজুর রহমান।
স্যার আমাকে স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। স্যারের অনুপ্রেরণায় স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিতর্ক ও কবিতা আবৃত্তিতে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। আমরা ১৯৮১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। কাজেই ১৯৮১ সালে আমরা স্কুল থেকে বিদায় নিয়ে যাই। এ সালে স্যারও সম্ভবত আমাদের স্কুল থেকে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান। এর পর থেকে স্যারের সাথে দীর্ঘ বৎসর যাবৎ দেখা হয় না। একদিন হঠাৎ করে দেখি স্যার বানিয়াচং বড় বাজারে একটি রাস্তার পাশে দাঁড়ানো। স্যারকে দেখা মাত্রই আমি স্যারের কাছে গেলাম। সম্ভবত বাজারেই আমি স্যারকে সালাম ও কদমবুসি করলাম। কারণ ইহা আমার পৈত্রিক শিক্ষা। স্যারকে বললাম, স্যার আমার বাসা আদমখানি, এখান থেকে ১০ মিনিটের রাস্তা। স্যার আপনি আমার বাসায় চলুন। স্যার বললেন, যাব একটি শর্তে। শুধু তোমার বাসায় চা খাব। আমি বললাম, ঠিক আছে স্যার। স্যার আমার বাসায় আসলেন। আমার ওয়াইফ সাহানা আক্তার খানমও স্যারকে সালাম ও কদমবুসি করলেন। আমরা স্যারকে দুপুরের খাবার খাওয়াইতে অনুরোধ করলাম। কিন্তু স্যার রাজি হলেন না। স্যারকে নাস্তা দিলাম। আমার ওয়াইফ স্যারকে বড় কাপে ভালো করে দুধের চা করে দিলেন। স্যার খুব খুশি হলেন। স্যার একদিন আমাকে বলেছিলেন, তোমার বউয়ের চায়ের কথা ভুলি নাই। আমার গফটের বাংলা প্রিয় স্যারকে বাসায় আনতে পেরে আমিও খুবই গর্বিত হলাম। ইহা প্রায় ১৫ বছর আগের ঘটনা। এক/দুই বছর আগের আর একটি ঘটনা। আমাকে দেখার জন্য একদিন স্যার আমার মাদরাসায় গেলেন। আমার তখন ক্লাস বিরতি ছিল। তাই আমি মাদরাসার পাশের রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম চা খেতে। মাদরাসার একজন অফিস সহায়ক আমার কাছে গিয়ে বললেন, স্যার! আপনার একজন ইয়ং বুড়ো স্যার আসছেন আপনাকে দেখতে। স্যারের বর্তমান বয়স প্রায় ৮০ বৎসর। আমি সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলাম শ্রদ্ধেয় শওকত স্যারই হবেন। গিয়ে দেখলাম আমাদের অধ্যক্ষ জনাব মাওলানা আবদাল খানের কাছে স্যার বসা। স্যারকে সালাম করার পর কদমবুসি করতে চাইলাম। স্যার কদমবুসি করতে দিলেন না, স্যারের বুকে টেনে নিলেন। মোবাইল–ফেইসবুক যুগ আসার পর মোবাইল ও ফেইসবুকের মাধ্যমেও স্যারের সাথে মধ্যে মধ্যে যোগাযোগ হয়। আমার ফেইসবুকের লেখাতে স্যার মধ্যে মধ্যে লাইক দিয়ে থাকেন এবং উৎসাহমূলক কমেন্ট করে থাকেন। স্যারের স্মৃতিকথা ফটোসহ দিন-তারিখ উল্লেখ করে ফেইসবুকে প্রেরণ করে থাকেন। আশ্চর্য হই স্যার নিজের স্মৃতিকথাগুলো, স্মৃতিগুলোর ফটো, দিন–তারিখসহ সংরক্ষণ করায়। আমিও স্যারের এগুলোতে প্রায়ই লাইক–কমেন্ট দিয়ে থাকি।
স্যারের গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং এর যাত্রাপাশা মহল্লায়। পিতার নাম জনাব মুনশি মোঃ সানাউল্লাহ। তিনি ১৯৫৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মাতার নাম : জনাবা আয়েশা খাতুন। তিনি ১৯৫৪ সালে ইন্তেকাল করেন। বড় ভাইয়ের নাম : জনাব প্রফেসর মোহাম্মদ আলী। তিনি ১৯৫০ সালে দর্শন শাস্ত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্হান অধিকার করেছিলেন। তিনি সিলেট এমসি কলেজের দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। তিনি চকবোর্ডে ডান ও বাম হাত দিয়ে সমান তালে লিখে একই সময়ে একই সরল রেখায় মিলাতে পারতেন। তিনি ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে ইন্সপেক্টর অব কলেজের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। তিনি হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। তিনি হবিগঞ্জ মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ছিলেন। বর্তমানে কলেজটি সরকারি। তার কণ্যাদের মধ্যে, প্রফেসর জনাবা জাহান আরা খাতুন, হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের অবসর প্রাপ্ত অধ্যক্ষ, প্রফেসর জনাবা শাহনাজ পারভীন, বৃন্দাবন সরকারি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল।
শওকত আলী স্যারের স্ত্রীর নাম :জনাবা সাহানা সুলতানা শেলী। তার একমাত্র বোনের নাম : মরিয়ম খাতুন। তিনি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। তিনি ১৯৩৪ সালে সুন্দর হাতের লেখায় আসাম প্রদেশের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন।
শওকত স্যারের দুই মেয়ে ও এক ছেলে।
বড় মেয়ে মুনিরা পারভীন। তিনি যুক্তরাজ্যে চ্যানেল এস এর সংবাদ পাঠিকা এবং একজন খ্যাতনামা আবৃত্তিকার। তিনি ১৯৯৮ সালে জাতীয় শিশু সপ্তাহ প্রতিযোগিতায় সুন্দর হাতের লেখায় দ্বিতীয় স্হান অধিকার করেছিলেন। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে রৌপ্য পদক গ্রহণ করেছিলেন। স্যারের দ্বিতীয় মেয়ের নাম : নাদিরা পারভীন চমন এবং ছেলের নাম : তারেক ইকবাল দীপ।
স্যার প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন রায়ের পাড়া প্রাইমারি স্কুল থেকে। মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এল আর হাইস্কুল, নবম শ্রেণিতে উঠে সিলেট চলে যান এবং সিলেট সরকারি পাইলট হাইস্কুলে ভর্তি হন। তিনি ১৯৬২ সালে উক্ত স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এর পর এমসি কলেজ থেকে আইএ এবং বিএ পাস করেন (১৯৬৬ সাল)। ১৮৭৪ সালে কুমিল্লা টিচার্স ট্রেইনিং কলেজ থেকে বিএড পাস করেন। ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেইনিং কলেজ থেকে এমএ ইন এডুকেশন পাস করেন। তিনি বহু ভাষাবিদ ছিলেন। তিনি ইংরেজি, উর্দু, আরবি এবং ফারসি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।
শওকত স্যার চট্টগ্রামের রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনি হাইস্কুল থেকে শিক্ষক হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। ১৯৭৮ সালে সরকারি কর্ম কমিশনের মাধ্যমে তিনি সরকারি হাইস্কুলে চাকুরিতে যোগদান করেন। সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে তিনি ২৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন, সুনামগঞ্জ পিটিআইয়ের সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদ থেকে ২০০৩ সালে। সিলেটের সীমান্তিক আইডিয়াল টিচার্স ট্রেইনিং কলেজের সহকারি অধ্যাপক পদ থেকে তিনি শিক্ষকতা জীবনের পুরোপুরিভাবে সমাপ্তি ঘটান। তিনি ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই শিক্ষকতা জীবনের ৫০’বছর অর্থাৎ অর্ধ শত বছর পূর্ণ করেন। তার দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর কর্ম সাধনার পূর্তির স্মারক হিসেবেই ‘শিক্ষাব্রতি শওকতআলী’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটিতে ২৯ জন লেখক–লেখিকার লেখা স্হান পেয়েছে।
প্রবাদে আছে, ‘মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে বয়সের মধ্যে নয়।’
কবির ভাষায়,
‘পিতা গড়ে শরীর শিক্ষক গড়ে মন
পিতা বড়ো না শিক্ষক বড়ো বলবে কোনজন।’
–কবি গোলাম মোস্তফা
পরিশেষে আমি আমার প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় স্যার জবাব শওকত আলী স্যারের মহান আল্লাহর নিকট দীর্ঘ জীবন ও সুস্বাস্থ্য কামনা করে আমার এ লেখা এখানেই শেষ করছি।
লেখিত : মোঃ হাফিজুর রহমান চৌধুরী, সিনিয়র শিক্ষক, বানিয়াচং সিনিয়র ফাযিল (আলিয়া) মাদরাসা
তথ্যসূত্র : কিছু আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এবং কিছু ‘শিক্ষাব্রতি শওকত আলী’ গ্রন্থ থেকে
লেখক : সহকারি শিক্ষক, সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা, বানিয়াচং।