আবুল কালাম আজাদ, যুক্তরাজ্য থেকে : আজ ১৮ অক্টোবর।বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার আদরের ছোট ছেলে শেখ রাসেলের জন্মদিন।
১৯৬৪ সালের এই দিনে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে আলোকিত করে এই দুনিয়াতে শেখ রাসেল জন্ম গ্রহণ করেন।
দীর্ঘ সাত বছর পর পরিবারে নতুন অতিথি এসেছিল বলে আনন্দের সীমা নাই !বঙ্গবন্ধু তখন বাড়িতে ছিলেন না। রাজনৈতিক প্রোগ্রামে চট্টগ্রাম ছিলেন। রাসেল নামকরণের সাথে ও রয়েছে এক ইতিহাস আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বই পড়ার প্রতি ছিল প্রচন্ড নেশা। লেখক দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের বই তিনি প্রচুর পড়তেন এবং বাংলা অর্থ সহকারে বঙ্গমাতা বেগম মুজিবকে শুনাতেন। বাবা মুজিব হয়তো সন্তানের মুখ দেখে অনুমান করেছিলেন- আমার এই সন্তান একদিন আপন প্রতিভায় দীপ্ত হয়ে উঠবে।হতে পারে একজন সেরা লেখক, দার্শনিক বা বিশ্ব শান্তির নতুন কোনো কান্ডারী। শহীদ রাসেলের অল্প বয়সের জীবন বিশ্লেষণ করলে আমরা সেটাই দেখতে পাই।শেখ রাসেল ছিল প্রচন্ড সাহসী, মানবিক ও রাজনৈতিক বোধ সম্পন্ন একটি ছেলে। শেখ রাসেলের যখন দুই বছরের কাছাকাছি তখন বঙ্গবন্ধু ৬ দফা পেশ করেন এবং পাকিস্তান সরকার তাঁকে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। রাসেল প্রথম বারের মতো তখন মায়ের সাথে কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে যান।
বঙ্গবন্ধু ‘কারাগারের রোজনামচা’য় এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি দুই বছরের কম বয়সী ছেলে এসে বলে আব্বা বাড়ি চলুন।বঙ্গবন্ধু তখন কি উত্তর দিবেন ওকে? রাসেলকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম রাসেল তো বুঝে না আমি কারাবন্দি। রাসেলকে বললাম তোমার মার সাথে বাড়ি যাও তুমি, আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো । ও কি বুঝতে চায়। কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তার আদরের ছোট ভাই রাসেলকে নিয়ে লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা‘ বই থেকে অনেক কিছু জানা যায়।

দেশরত্ন শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আব্বার সাথে প্রতি ১৫ দিন পর পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে আর আসতে চাইতো না, খুব কান্নাকাটি করতো। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে আব্বার বাসা জেলখানায়। আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা আমাদের বাসায় চলে যাব বেশ কষ্ট করে ওকে নিয়ে আসতে হতো। আর তখন আব্বার মনের অবস্থা যে কি আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায়ও আব্বার জন্য কান্না করলে মা ওকে বোঝাতো, আমিই তোমার আব্বা। আমাকেই আব্বা বলে ডাকো, পরে মাকেও আব্বা বলে ডাকতো। একদিন বললো হাসু আপা তোমার আব্বাকে একটু আব্বা বলে ডাকি।’
রাজনৈতিক সচেতনতার কথাও আমরা জানতে পারি, ছোট্ট রাসেল একদিন মাকে জিজ্ঞেস করে মা আব্বার কাছে যাবে না? মা কোনো উত্তর দেয় না। দিবে কি করে তখন যে ছয় মাস ক্যান্টনমেন্টে আটকে রাখা হয়েছিল। কেউ কোনো খবরই জানতো না কোথায় আছেন বঙ্গবন্ধু। ছেলেকে শুধু বুকে টেনে নিয়ে আদর করতেন মা। রাসেল আবার জিজ্ঞাসা করলো মা আব্বার নাকি ফাঁসি হবে? মা ফাঁসি কি? মা বললেন তোমাকে একথা কে বলেছে ? রাসেল উত্তর দেয় সেদিন কাকা, দুলাভাই আর কামাল ভাই বলেছিল আমি শুনেছি মা। এমনই রাজনৈতিক সচেতন ছিল শেখ রাসেলের।বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলে জয় বাংলা স্লোগান দিত ছোট রাসেল।
এমনকি হরতালের দিনে বাসার সামনের লনে দাঁড়িয়ে হরতাল হরতাল বলে স্লোগান দিয়ে মাতিয়ে রাখত।
রাসেল পিতার সান্নিধ্য বেশি না পেলেও যখন পেতো তখনই বঙ্গবন্ধুকে সবসময় অনুকরণ ও অনুসরণ করতো। জামা-জুতা হাঁটার স্টাইলসহ সব কিছুই অনুকরণ করতো। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় পোশাক ছিল লুঙ্গি ও গেঞ্জি।সেজন্য রাসেলেরও ছোট লুঙ্গি ছিল। বঙ্গবন্ধুর চশমাটাও মাঝে মাঝে নিজের চোখে নিয়ে মজা করতো।
বঙ্গবন্ধু ও যখনই সময় পেয়েছেন তখনই রাসেলকে সময় দিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন বিভিন্ন দেশ সফরে রাসেলকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। রাসেল খুবই চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। সারাক্ষণ বাড়ি মাতিয়ে রাখতো।রাসেলের প্রিয় ছিল সাইকেল। দু’টো সাইকেল ও ছিল একটি লাল, অন্যটি নীল। এখনও সাইকেল দু’টো বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
অন্য একটি গুণ ছিল আতিথেয়তা। যে কেউ আসলেই নাস্তায় জন্য চিৎকার শুরু করে দিতেন। আথিথেয়তা বঙ্গবন্ধু পরিবারের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট।
সমাবর্তন উপলক্ষে ১৫ই আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের।
বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট জানানোর জন্য ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের পক্ষ থেকে বাছাই করা হয়েছিল ৬জন সদস্যকে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র শেখ রিসাল উদ্দিন (রাসেল)। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে তার আর স্যালুট জানানো হয়নি।
সেদিন যদি শহীদ না হতেন তাহলে আজ ৫৭ বছরে পদার্পণ করতেন শেখ রাসেল। তাহলে নিশ্চয়ই তার প্রিয় হাসু আপার সাথে থেকে আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের পক্ষে কাজ করতেন। নেতৃত্ব দিতেন দেশ জাতি ও সমাজ গঠনের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হারিয়েছেন তার আদরের সবচেয়ে প্রিয় ছোট ভাইকে আর বাংলাদেশ হারিয়েছে একজন সম্ভাবনাময় প্রতিভাবান ছেলেকে। শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু-কিশোর তরুণের কাছে ভালোবাসার নাম। একটি নিষ্পাপ শিশু হিসেবেই চিরকাল অমর হয়ে থাকবে শেখ রাসেল। ইতিহাসের মহাশিশু হয়েই চিরদিন বেঁচে থাকবে প্রতিটি বাঙ্গালির হৃদয়ে। খুনিরা তাঁকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর উত্তারাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, তাদের সে অপচেষ্টা শতভাগ ব্যর্থ হয়েছে। শহীদ শেখ রাসেল সব সময় বেঁচে থাকবে বাংলাদেশের সব শিশুর অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে, অবহেলিত অধিকার বঞ্চিত শিশুদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক হিসেবে। শেখ রাসেল তুমি মৃত নও, বেঁচে আছো কোটি বাঙালীর হ্নদয়ে। শুভ জন্মদিন, শহীদ শেখ রাসেল।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক, যুক্তরাজ্য।