তরঙ্গ ডেস্ক : বিজ্ঞানবিষয়ক মার্কিন সাময়িকী সায়েন্সনিউজ-এর দৃষ্টিতে ২০২০ সালের উল্লেখযোগ্য ১০ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন বাংলাদেশের তনিমা তাসনিম। যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজে গবেষণা করেন তিনি। গত ২৭ ডিসেম্বর জুম সফটওয়্যারের মাধ্যমে ২৯ বছর বয়সী এই তরুণ বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. সাইফুল্লাহ।
আমরা আপনার গবেষণার বিষয়টা দিয়ে শুরু করতে পারি। কৃষ্ণগহ্বরের মতো জটিল বিষয় হয়তো পুরোপুরি বুঝব না। তবু যদি একটু সহজ করে বলেন…
প্রতিটা ছায়াপথেই বড় বড় কৃষ্ণগহ্বর থাকে। এই কৃষ্ণগহ্বরের ভর সূর্যের চেয়ে লাখ-কোটি গুণ বেশি। যখন এই কৃষ্ণগহ্বরগুলো সক্রিয় থাকে, তখন এ থেকে আমরা প্রচুর রেডিয়েশন বা বিকিরণ দেখতে পাই। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে আট মিনিট সময় লাগে। অর্থাৎ সূর্যে যদি কিছু ঘটে, সেটা আমরা আট মিনিট পর জানতে পারব। সূর্য থেকে আরও দূরে থাকা এমন অনেক বস্তু আছে, যেখান থেকে আলো আসতে আরও বেশি সময় লাগে। অতএব যখন টেলিস্কোপ দিয়ে মহাকাশের দিকে তাকাই, আমরা শুধু অনেক অনেক দূরের বিষয় নয়, অনেক অতীতের বিষয়ও জানতে পারি। ১ হাজার ২০০ কোটি বছর আগের কিছু সক্রিয় কৃষ্ণগহ্বরও আমরা দেখতে পাই। কৃষ্ণগহ্বরের মৌলিক উপাদান তিনটি—চার্জ, ভর আর ঘূর্ণন। অর্থাৎ এটা কত দ্রুত ঘুরছে। আমি যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর মডেলটা তৈরি করেছি, তার মাধ্যমে এই মৌলিক উপাদানগুলো পরিমাপ করতে সুবিধা হবে, সেই সঙ্গে এটা ছায়াপথের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, সেটাও আমরা জানতে পারব। এটা কৃষ্ণগহ্বরের প্রকৃত চিত্র নয়। কিন্তু অনেকগুলো কৃষ্ণগহ্বরের উপাত্ত থেকে পাওয়া একটি পরিসংখ্যানগত চিত্র। আমার এই কাজটি দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল-এ প্রকাশিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সায়েন্সনিউজ-এর দৃষ্টিতে আপনি ২০২০ সালের উল্লেখযোগ্য ১০ বিজ্ঞানীর একজন। কেন তাঁরা আপনার কাজটি বিশেষভাবে মূল্যায়ন করছে?
যত দূর জানি, সায়েন্সনিউজ-এ নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী, আমেরিকান অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল সোসাইটির সদস্য বা এর আগে যাঁরা এই তালিকায় ছিলেন, তাঁরাই নাম মনোনয়ন দেন। আমি জানি না কে আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। গবেষণার কাজ জানান দিতে পারলে বেশ ভালো, তাতে দারুণ সব মানুষের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়। আমাদের কাজটা জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার পর বেশ কিছু সুযোগ পেয়েছি। যেমন আমাকে অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল থেকে আহ্বান জানানো হয় পেপার রিভিউ করার জন্য। নাসা কোন কোন গবেষণা প্রকল্পকে তহবিল দেবে, তা নির্ধারণ করতে তাঁদের প্যানেলের সঙ্গে কাজ করার আমন্ত্রণও আমি পেয়েছি। এসব থেকে ধারনা করতে পারি, আমার গবেষণা অনেকের মনোযোগ আকর্ষন করেছে।
শুনেছি মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে যখন পড়তেন, তখন থেকেই আপনার আগ্রহ জ্যোতির্বিজ্ঞানে।
একদম ক্লাস ওয়ান থেকেই এই ইচ্ছা। ছোটবেলায় আম্মু যখন খবরের কাগজ পড়ে আমাকে জানালেন, পাথফাইন্ডার মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করেছে, আমি বললাম গ্রহ কী? আম্মু বুঝিয়ে বললেন, পৃথিবীর মতোই একটা গ্রহ, যেখানে সবকিছু লাল…আস্তে আস্তে বুঝলাম, পৃথিবীর বাইরেও অনেক বড় একটা জগৎ আছে। আমাদের অস্তিত্ব সেখানে খুব ছোট। তখন থেকেই ঠিক করে ফেলেছিলাম, আমি জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে পড়ব।
বিজ্ঞাপন
তখন থেকেই কি নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন?
মানারাতে একটা চমৎকার কম্পিউটার ল্যাব ছিল, সেখানে আমি মনের মতো কোডিং (প্রোগ্রামিং সংকেত লেখা) করতে পারতাম। লাইব্রেরিতে প্রচুর বিজ্ঞানকল্পকাহিনি ছিল, সেসব বই পড়তাম। এভাবেই ধীরে ধীরে আগ্রহ বেড়েছে। পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, কোডিং—এসবের প্রতি ভালো লাগা তো আছেই, সমস্যা সমাধানের প্রতি আমার সব সময় ঝোঁকও ছিল। দেখা গেল কোনো একটা কারণে মানসিক চাপে আছি, আমি অঙ্ক করতে বসে যেতাম। গান শুনতে শুনতে কোডিং করতাম। একটা কিছু বোঝার মধ্যে আনন্দ আছে। হয়তো এটি আপনার পরবর্তী জীবনে কোনো কাজে আসবে না, তবু। রিচার্ড ফাইনম্যান নামে একজন পদার্থবিদ আছেন, তিনি ‘দ্য প্লেজার অব ফাইন্ডিং থিংস আউট’ বিষয়ে অনেক কিছু লিখেছেন, তাঁর কথাগুলোর কিছু ইউটিউব ভিডিও আছে। তিনি যেভাবে বিজ্ঞান চর্চা করার আনন্দ বর্ণনা করেছেন, আমার কাছে সেটা বাস্তবের কাছাকাছি মনে হয়।
জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে যেহেতু ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল, এ লেভেলের পর যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিন মার কলেজে যখন জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে গেলেন—তখন এমন কোনো মুহূর্ত কি এসেছে, যখন মনে হয়েছে এই মুহূর্তটার জন্যই তো আমি অপেক্ষা করছিলাম। কিংবা এমনটাই তো সায়েন্স ফিকশন বইতে পড়েছি!
গল্প তো আদতে গল্পই। এর সঙ্গে বাস্তব মেলে না। তবে ব্রিনমারের হ্যাভারফোর্ড কলেজে পড়ার সময় ‘ইউরেকা’ বলার মতো অনেক মুহূর্ত এসেছে। জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত প্রোগ্রামিংটা ঝালাই করতে পেরেছিলাম বলেই আমি পরে নাসা বা সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সার্নের (দ্য ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ) মতো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশির সুযোগ পেয়েছি। আমার সৌভাগ্য—সার্নে যখন ছিলাম, ২০১২ সালে, তখনই হিগস-বোসন কণার অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়। ব্রিটিশ পদার্থবিদ পিটার হিগস তখন এসেছিলেন। তাঁর মতো একজন ‘রকস্টার’ পদার্থবিদকে সামনাসামনি দেখা এক পরাবাস্তব অনুভূতি! নাসায় আমি অ্যাডাম রিজকে দেখেছি, তিনি ১৯৯৮ সালে ডার্ক অ্যানার্জি আবিষ্কার করেছিলেন।
আপনি বিখ্যাত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। ইয়েলের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। এই যাত্রায় এমন কোনো শিক্ষা কি আছে, যেটা আপনি তরুণদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চান?
কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। ইদানীংকালে গ্রোথ মাইন্ডসেট (আরও ভালো করার মানসিকতা) বলে একটা কথা খুব শোনা যায়। এ সম্পর্কে স্ট্যানফোর্ডের অধ্যাপক ক্যারল ডোয়েকের একটা ছোট বই আছে। পড়ে দেখতে পারেন।
সূত্র : প্রথম আলো