।। আবু সালেহ আহমদ ।।
চাহিদা আর প্রাপ্তি সব মানুষেরই সমান থাকে না। ঠিক তেমনি প্রতিভা নিয়ে কারো জন্ম হয় না, ব্যক্তি সমাজ কিংবা সভ্যতার প্রয়োজনে কিছু মানুষ প্রতিভাবান হয়ে ওঠেন । তারা নিজের শ্রম মেধা দিয়ে নশ্বর এ পৃথিবীতে যশ, কীর্তি- খ্যাতি রেখে যান। এমন অনেকেই আছেন ধন-ধৌলতসহ কোন কিছু প্রাপ্তির আশা না করে কাজ করার নির্মোহ অভ্যাস তৈরি করেছেন নিজের অজান্তে। প্রাপ্তি কতটুকু তার হিসাব নিকাশ তাকে স্পর্শ করে না এরকম অনেকের মধ্য একজন মফস্বল সাংবাদিক হাফেজ ছিদ্দিক আহমদ।
প্রত্যয় ২য় বর্ষ ১ম সংখ্যা এড: শাহজাহান বিশ্বাস লিখেছেন।
৮৩ বৎসর বয়সে এখনো তিনি লিখেছেন, সামাজিক সালিশি আচার বিচারে বিভিন্ন সামাজিক ও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশিষ্ট রয়েছেন। ১৯৫৩ সালে যুগভেরীতে প্রথম নিজের নামে এলাকার সংবাদ প্রকাশে গোপন আকাঙা নিয়ে রিপোর্টিং শুরু করেন সেই যে শুরু থামেননি এখনো। পিছিয়ে পরা মানুষ তথা গ্রামের সব কিছুই তিনি তাঁর পত্রিকায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এক পর্যায়ে তাঁর সব মানুষের দুঃখ দুর্দশার প্রতিচ্ছবি প্রকাশে যেন দায়বদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি অবহেলিত এক বৃহৎ বানিয়াচং গ্রামের সমস্যা মিথ্যা কেলেংকারী, নির্যাতন, দুর্নীতি, সংঘর্ষ, আশা-আকাঙার কত সংবাদ যে পুরো জীবনে লিখেছেন তার হিসাব মিলেনি এখনো। ১৯৬২ সালে নিয়োগ পান দৈনিক আজাদে ।এরপর বাংলার বাণী, ইত্তেফাক, দৈনিক কৃষাণ, সিলেটের ডাক, সাপ্তাহিক নয়া বার্তা, গণমুক্তি ও স্থানীয় পত্রিকায় নিজস্ব সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দীর্ঘ দিন হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই সাথে বানিয়াচং প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। আজ তিনি নেই। তিনি নশ্বর এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন পরপারে। কিন্তু এ মানুষটির স্মৃতি আজো কাঁদায়। তিনি ছিলেন বানিয়াচংয়ের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে জীবন্ত এক বাঁতিঘর। ছিলেন আমাদের জন্য এক বিশাল বটবৃক্ষ। হাফেজ ছিদ্দিক আহমদ বানিয়াচং নন্দি পাড়া গ্রামে ১৯৩০ সালে ২২শে ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ক্বারী মুমিন উদ্দিন বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনে ও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। জীবদ্দশায় এক সাক্ষাৎকারে হাফিজ ছিদ্দিক আহমদ বলেছিলেন, অল্প বয়সেই কোরআন হিফজ সমাপ্ত করে স্থানীয় মাদ্রাসা হতে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তখন থেকেই সমাজ তথা মানুষের কল্যাণে কাজ করার অদম্য স্পৃহা জন্মে। প্রথমে সাব রেজিষ্টার অফিসে নকল নবিস হিসাবে কিছুদিন কাজ করার পর ১৯৬২ সালে স্থানীয় বড় বাজারে হোমিও চিকিৎসায় মনোনিবেশ করেন এবং অনেক গরীব রোগীদের বিনা পয়সায় ঔষধ প্রদান করে মানব সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি ছাত্রদের নিয়ে মিছিল মিটিং করেছেন অনেকবার। ১৯৬০ এর দশকে সময় ছিল হাতেগুনা পত্রিকা ও সাংবাদিক সব পত্রিকাতেই এ সময় লেখার সুযোগ ছিল। যেখানেই লেখার সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন, রির্পোট করেছেন এজন্য প্রশাসন তথা মানুষের যেমনি হয়েছেন আপন তেমনি শত্রুও হয়েছেন অনেকবার। ১৯৬৯ তিনি সংগ্রাম পরিষদের গঠনে অনন্য ভূমিকা পালন করেন, তিনি ছিলেন ঐ কমিটির সাধারণ সম্পাদক। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তা সংগঠনিক ভূমিকার কারণে পাক সেনারা তাঁর বাড়ি আক্রমণ করে। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। পরবর্তী সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে ২টি মামলা করা হয়েছিল। তিন রাত উপেক্ষা করে একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত লুকিয়ে ছিলেন অনেক দিন। সংগ্রামের শুরুতেই তিনি অন্যান্যের সাথে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে স্বাধীনতা আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা পালন করেন। এসময় তিনি বানিয়াচং এর বিভিন্ন মহল্লা ও পাড়ার সর্দারদের দলে অন্তর্ভুক্তি করার এক অভিনব কৌশল করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বেশ সফলতাও পেয়েছেন। তিনি ছিলেন সংগ্রাম পরিষদের ও পরবর্তীতে থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক। সাংবাদিকতা সমাজ সেবা রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি হাফেজ ছিদ্দিক আহমদ শিক্ষা উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সুরভী, তুষার স্মৃতি, মেধাবিকাশ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অবদান অনস্বীকার্য।জনাব আলী কলেজ, এল.আর হাই স্কুল, বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মেধাবিকাশ, আলিয়া মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব থেকে শিক্ষা উন্নয়নে দৃঢ়তার সাথে কাজ করে আসছেন।
বানিয়াচং শাহী ইদগাহা নির্মাণে এ মানুষটির বিরাট অবদান রয়েছে। ১৯৬৫ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শাহী ঈদগাহের পরিচালনা পর্ষদের ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। সবকিছু আছে, নেই শুধু তিনি। আজকের এ সময়ে এ মহান মানুষটির আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক- গবেষক ও সাহিত্যিক।