তাহমিনা বেগম গিনি : দিনটি ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট।তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১৩ নং রুমের আবাসিক ছাত্রী।ঐ দিনটি ছিল আমাদের এম,এ ফাইনাল পরীক্ষার শেষ পরীক্ষা ভাইবা। ১৪ ই আগস্ট সারারাত আমার গুলি পটকার আওয়াজ শুনেছি।হলের ছাত্রলীগের মেয়েরা বলাবলি করছিল ১৫ তারিখ শেখ সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন, তাই আনন্দে ছেলেরা এসব করছে।আমাদের হলটিকেও খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল ।কারণ আমাদের হলের ৫ম তলা উদ্বোধন করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আসার কথা ১৫ই আাগস্ট।সকালে হৈ চৈ এ ঘুম ভেঙ্গে গেল।আমার রুমমেট রুনা,নাজু জানালো গেটে নিরাপত্তা প্রহরী থাকা সত্ত্বেও কে বা কারা একটি পাকিস্তানী পতাকা লাগিয়েছে। সবাই বড় অবাক হোলাম ! রাতের অন্ধকারে ৩২নংসহ ঢাকা শহরে কিনারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটে গিয়েছে আমরা এর কিছুই জানি না।সকাল ৮ টয় দেখলাম সবাই কমন রুমে রেডিও শুনতে দৌঁড়াচ্ছে।আমিও গেলাম। মেজর ডালিমের নিজর কন্ঠে শুনলাম সেই মর্মন্ত্তু সংবাদ।

শেখ সাহেব ইজ নো মোর।কমনরুম কান্নায় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লো । বিশেষ করে ছাত্রলীগের নেত্রীদের ক্রন্দনে।আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো যখন বঙ্গবন্ধুর বড় ছবিটি হল স্টাফ রাজা ভাই ভেজা চোখে নামিয়ে নিয়ে গেলো।আমরা হল বারান্দায় বসে রইলাম কয়েকজন।সবাই হল ছাড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।মনে কত কথা আকুলি- বিকুলি করছে তখন।শেখ কামালের স্ত্রীর চেহারাটা চোখের সামনে ভাসছে।বিয়ের পরও এসেছে হলে।আমাদের সাথে পরীক্ষার্থী ছিল সে । শেখ কামালও। তারা সবাই কেমন আছেন। হঠাৎ দুটো আর্মি জীপ হলে ঢুকে আমাদের সামনে থামলো। দুজন অফিসার বললেন আমরা এম্এর ছাত্রীদের সাথে কথা বলতে চাই। আমরা পরিচয় দিতেই বললেন, এখন মুজিব নেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের মাঝে কেউ একজন সাহস করে প্রশ্ন করেছিল,অন্যদের কথা।অফিসারদ্বয় জানালেন সবাই মৃত।আপনারা ভয় পাবেন না। আর এক ফোটা রক্ত বাংলাদেশে পড়বে না। ফাইনাল ইয়ার বাদে সবাই হল ত্যাগ করবেন। এত কষ্ট কোনদিন পাইনি।এত আতঙ্কও বোধ করিনি কোনদিন। সবাই হল ত্যাগ করলো। আমরা গুটি কয়েক মেয়ে রয়ে গেলাম।আশ্চর্য হলাম,একটি মিছিল হয়নি,একটি শ্লোগান শুনিনি।তখন মনে হচ্ছিল সব স্বাভাবিক। কোথাও কিছু হয়নি।কিছুূদিন পর ভাইবা পরীক্ষা দিয়ে অনেক ভালো লাগার ১১৩নং রুম কলাভবন ছেড়ে চলে আসি।কিন্তু আমার আজও মনে হয়—–
“যদি রাত পোহালে শোনা যেত
বঙ্গবন্ধু মরে নাই—।
তাহলে আমাদের বেঁচে থাকাটা অন্যরকম হতো।
এই মহানেতার প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।
সেদিনের সব শহীদানদের প্রতি আমার চোখের জল।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক মেধাবী ছাত্রী, কবি ও সাহিত্যিক, হবিগঞ্জ।