
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ভিডিও গেমসের আবিষ্কার হয় ১৯৪০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে। তারপর সত্তর-আশির দশকের মধ্যে এটি জনপ্রিয়তায় পোঁছে। সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে নির্মিত আর্কেড টাইপের ভিডিও গেম-এর নাম ছিল কম্পিউটার স্পেস। এরপর আটারি কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসে বিখ্যাত গেম পং। তারপর ধীরে ধীরে আটারি, কোলেকো, নিনটেনডো, সেগা ও সনির মতো ব্যবসায়ী কোম্পানিগুলো নানা উদ্ভাবন ও প্রচারণা চালিয়ে কয়েক দশকের মধ্যে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে মানুষের ঘরে পোঁছে দেয় পুঁজিবাদী সভ্যতার এ বিনোদনপণ্য। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে প্রায় ২২০ কোটি মানুষ নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে ভিডিও গেম খেলে থাকে। যাদের অধিকাংশই হচ্ছে অল্প বয়সী শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণী। পাবজি! ফ্রি ফায়ার! প্লেয়ার্স আননোন ব্যাটেল গ্রাউন্ড! বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইলন গেম। বর্তমানে উপমহাদেশে কয়েকগুণ বেড়েছে এই গেমের জনপ্রিয়তা। মোবাইল ফোন এবং কম্পিউটার দুটোতেই খেলা যায় এই গেম। তবে উপমহাদেশে পাবজির কম্পিউটার ভার্সনের থেকে মোবাইল ভার্সনটিই বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে এখন প্রতি মাসে প্রায় ২২৭ মিলিয়ন মানুষ এ গেম খেলে। আর প্রতিদিন খেলে প্রায় ৮৭ মিলিয়ন মানুষ। লাখো গরিবের দেশ বাংলাদেশেও প্রতিদিন এ গেম খেলছেন ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ! সব মিলিয়ে মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের পর্দায় শিশু- কিশোরেরা ‘পাবজি’তে এতটাই মগ্ন থাকছে যে, বাস্তব পৃথিবী ভুলে তারা এক বিপজ্জনক নেশায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। বর্তমানে এই গেমে অত্যধিক আসক্ত হয়ে পড়ছে শিশু থেকে শুরু করে কিশোর এবং তরুণরাও। একটু একটু করে খেলতে খেলতে পুরোপুরি আসক্ত হয়ে যায় শিশু-কিশোররা। যার ফলে পরিবার ও স্বজনদের থেকে নিজেকে অনেকটা আলাদা করে রাখতে শুরু করে। মোবাইল ফোন নিয়ে বাসায়, রাস্তাঘাটে, খেলার মাঠে,পাড়ায় পাড়ায় দলবেঁধে, রাত জেগে একা রুমে বসে এ গেমস খেলে থাকে সারাক্ষণ। শিশু কিশোরেরা পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। যে সময়টা পড়ার টেবিলে বসে থাকার কথা সেই সময় কাটে গেমস খেলেই। এতে শিশু কিশোরেরা দিন দিন প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যক্রম থেকে সরে আস্তে আস্তে অন্ধকারে যে নিমজ্জিত হচ্ছে তা ঠেরই পাচ্ছে না। শিশু কিশোরেরা নির্ধারিত সময়ে পাঠ্যবই থেকে জ্ঞান অর্জন করে নিজের জীবনকে প্রস্ফুটিত করার লক্ষ্যে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করার কথা থাকলেও তা এখন ভিডিও গেমস ও ইন্টারনেটে আসক্তির কারণে শিশু কিশোরদের জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব গেমে আসক্তিতে শিশু কিশোররা পড়াশোনায় ক্ষতির পাশাপাশি পারিবারিক,শারিরীক, সামাজিক, মানসিক রোগের কারণও হতে পারে। অনেক সরলমনা অভিভাবক হয়ত ভাবতে পারছেন না যে, এই তুচ্ছ বিনোদনটি এত মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে! বস্তুত এ হচ্ছে পুঁজিবাদী সভ্যতার বিনোদন। যা শুধু টাকার বিনিময়ে কথিত আনন্দ দিয়েই ছাড়ে না। উপরি পাওনা স্বরূপ কেড়ে নেয় সময়, সম্পদ, মেধা, সুস্থতাসহ অনেক কিছু! এখানে তার সামান্য উল্লেখ করা হচ্ছে। আজকাল ছোটদের অনেকের চোখেই পাওয়ারি চশমা ঝুলতে দেখা যায়। চশমা ছাড়া শিশুরা চোখে ঝাঁপসা দেখে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর কারণ হলো ডিজিটাল মাদকাসক্তি। দিনরাতের একটা দীর্ঘ সময় স্মার্টফোন, ট্যাব ও কম্পিউটারের স্ক্রীনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্ষীণ দৃষ্টিতে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। চিকিৎসকদের ভাষায় এ রোগের নাম ‘মায়োপিয়া’। ২-৩ বছরের শিশুরাও এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসকদের তথ্য অনুযায়ী ৮-১৪ বছরের শিশুদের চোখের সমস্যা বাড়ছে। ডাক্তারের পরীক্ষা, রোগী ও অভিভাবকদের কথায় জানা গেছে, মোবাইল-কম্পিউটারে অতিরিক্ত গেমস খেলা এবং টিভি দেখার কারণে শিশুর চোখের সমস্যার সৃষ্টি হয়। বেশ কয়েকজন অভিভাবক ও শিশুদের দেয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, তারা গড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ডিজিটাল ডিভাইসের পেছনে ব্যয় করে, যার বড় অংশই একাডেমিক বা ব্যবসায়িক প্রয়োজনের বাইরে। এছাড়াও মোবাইল ফোন পকেটে রাখলে ভ্রুণের কোয়ালিটি কমে যাওয়া, বুক পকেটে রাখলে হার্টের সমস্যা দেখা দেয়া, আঙ্গুলে ও ঘাড়ে ব্যথা, কানে কম শোনা এবং ডিসপ্লে থেকে জীবাণু ব্যাকটরিয়ার সংক্রমণসহ অসংখ্য শারীরিক ঝুঁকির আশংকা রয়েছে! এ ভয়ঙ্কর ডিভাইস থেকে মুক্তি পেতে সমাজের প্রত্যেক সচেতন সুনাগরিকদের পরিবারের, বিশেষ করে শিশু কিশোরদের প্রতি দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকলে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা লাঘব হবে।