ঢাকা ১০:১৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo বানিয়াচংয়ে হবিগঞ্জ শিক্ষা-সংস্কৃতি উন্নয়ন পরিষদের উদ্যোগে মেধাবৃত্তি পরীক্ষা-২০২৩ অনুষ্ঠিত Logo বানিয়াচং ইসলাহুল উম্মাহ পরিষদের উদ্যোগে মেধাবী ও কৃতি শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ Logo হবিগঞ্জ-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিলেন এমপি মজিদ খান Logo বানিয়াচং উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভা Logo নৌকা মার্কার সমর্থনে বানিয়াচং দক্ষিণ যাত্রাপাশা বনমুথুরা ভূমিহীন নারী-পুরুষের মিছিল Logo বানিয়াচংয়ে সরকারি প্রণোদনার ৭ হাজার ১শ’ কৃষককে সার-বীজ প্রদান Logo বানিয়াচংয়ে ফারুক চৌধুরী মিতুর মৃত্যুতে আলহাজ্ব রেজাউল মোহিত খানের শোক Logo বর্ণাঢ্য আয়োজনে আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল কোরআন মাদ্রাসার বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত Logo এমপি আব্দুল মজিদ খানকে দলীয় নমিনেশন দেওয়ার দাবীতে বানিয়াচং ২নং ইউনিয়ন আ’লীগের সভা Logo বানিয়াচং ৫/৬নং ভূমি অফিসের তহশিলদার রেজাউল করিম স্ট্যান্ড রিলিজ

বিজ্ঞানকে কোন নজরে দেখে ইসলাম

  • তরঙ্গ ২৪ ডেস্ক :
  • আপডেট সময় ০৮:০৫:১৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ জুলাই ২০২০
  • ১৪৬ বার পড়া হয়েছে
মুসা আল হাফিজ :
বিজ্ঞান ও ইসলামে বিরোধ কেন নেই, সেটা অনেকেই বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু বুঝতে না পারা ও না চাওয়াদের সংখ্যা কম নয়। এক ‘মাওলানা’ কমেন্ট করেছেন -” বিজ্ঞানে যা আছে,সবই ইসলামে আছে। একটি থেকে আরেকটি আলাদা নয়। বিজ্ঞানের যা কিছু ইসলাম সমর্থন করে, তা চলবে, যা ইসলাম সমর্থন করে না, তা চলতে পারে না।”
কমেন্টটি অজ্ঞতাজাত হলেও এ মানসিকতা লালন করেন হাজার হাজার মানুষ। ফলে বিষয়টা খোলাসা করতে চাইছি।
বিজ্ঞানের সকল সমাধান ইসলামে আছে, মনে করাটা ইসলাম সম্পর্কে ভুল বুঝার ফসল। নবুওতের কাজ স্বরূপ এবং নবীদের মিশন কী ও কেন, সেটা পরিষ্কার না থাকলে এ সমস্যা থাকবেই। সেটা বুঝার জন্য শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর রহ. বয়ান শোনা যেতে পারে।
হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায় তার ভাষ্য- যে বিষয়গুলোর সাথে চারিত্রিক পরিশুদ্ধির সম্পর্ক নেই কিংবা যে বিষয়গুলো জাতীয় রাজনীতি থেকে আলাদা, সেগুলোর প্রতি নবীগণ মোটেও ভ্রুক্ষেপ করেন না। যেমন বৃষ্টির কারণ ও প্রকৃতি, সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের কার্যকারণ, রঙধনু সৃষ্টির কারণ,বৃক্ষ ও প্রাণিজগতের রহস্য, চাঁদের গতি ও সূর্যের পরিক্রমা, নিত্যকার ঘটনাপ্রবাহের কারণ,নবী কিংবা রাজা – শাসকদের ইতিহাস, বিভিন্ন নগর- জনপদের ইতিকথা ইত্যাদি নিয়ে নবীগণ চিন্তা- ভাবনা করেন না। তবে এসবের যা কিছু জনপ্রিয় হয় এবং মানুষের বিবেক যাকে কবুল করে নেয়, তখন নবীগণও পরোক্ষভাবে সেগুলোর উল্লেখ করেন আল্লাহর মহিমা বর্ণনার নিমিত্তে। সেগুলোর মর্মকে ব্যক্ত করেন রূপকার্থে। এ কারণেই জনগণ যখন চাঁদের হ্রাস- বৃদ্ধি সম্পর্কে আল্লাহর রাসূলকে ( সা.) প্রশ্ন করলো, তখন তার পক্ষ থেকে আল্লাহ পাক সরাসরি এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বর্ণনা করলেন চাঁদের হ্রাস- বৃদ্ধির ফলে দিন- রাত নির্ধারণের উপকারিতার কথা। বলেন- তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করছে চাঁদ সম্পর্কে। হে রাসূল! বলে দিন, চাঁদ মানুষের জন্য নির্ধারণ করে সময়, নিরূপণ করে হজ্বের কাল।”
শিবলী নোমানী রহ. শাহ ওয়ালিউল্লাহ এর বক্তব্য উল্লেখ করে মন্তব্য করেন,- ‘নবীদের শিক্ষা ও নীতি সম্পর্কে তিনি যে বর্ণনা পেশ করলেন, এরপর কে বলতে পারে, বিজ্ঞান ও আধুনিক জ্ঞানের কারণে ধর্মের ক্ষতি হবার ভয়?’
আমি এখানে যোগ করতে চাই আরেকটি বিশেষ দিক।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ এখানে যা বলেছেন,এটা নবীদের মিশন তথা ইসলাম বনাম বিজ্ঞান সম্পর্কে মৌলিক বক্তব্য। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের যে সব বিষয় আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের, নবীগণ সেটা শেখাতে আসেন না। এগুলো তাদের লক্ষ্য ও মিশনের অন্তর্ভুক্ত নয়। বৈজ্ঞানিক ব্যাপারাদি পর্যবেক্ষণযোগ্য। এগুলো নিয়ে চিন্তাশীল যে কোন জ্ঞানী প্রজ্ঞা ও গবেষণাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে সমাধানে পৌছাতে পারে। কিন্তু নবীদের কাজ মানুষের বিশ্বাস,মূল্যবোধ ও চরিত্র সংস্কার। তাঁরা এই সংস্কারের ফর্মুলা পেশ করেন। ধর্মে থাকে বিশ্বাস ও কর্মের পরিশুদ্ধির বীধিলিপি। বস্তুগত গবেষণা, যন্ত্রপাতি আবিষ্কার,গণিত ইত্যাদি শেখানোর জন্য কুরআন নাযিল হয়নি, দ্বীন আগমন করেনি। অতএব ইসলামের মধ্যে সকল বৈজ্ঞানিক সমাধান থাকবে,এটা আশা করাই ভুল। হাম,শ্বেত,প্লেগ,ক্যান্সার,এলার
্জি, সার্স,মার্স,কোভিড ৯ ইত্যাদি রোগের চরিত্র,প্রকৃতি বলে দেবে কুরঅান- সুন্নাহ, বাতলে দেবে চিকিৎসার নিয়ম! – এটা আশা করাই ভুল। কীভাবে বিমান বানাতে হবে, কীভাবে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে হবে,কীভাবে উপগ্রহ পাঠাতে হবে,এসবের ফর্মুলা শরীয়ত থেকে কামনা করাটা সোনা দিয়ে মাটির কলস বানানোর ইচ্ছের সমান!
তাহলে কি তিব্বে নবী বা নবীজীর সা. চিকিৎসা বিষয়ক হাদীস প্রমাণিত নয়? কুরআন- হাদীসে বৈজ্ঞানিক বিবিধ বিষয় আলোচিত নয়?
চিকিৎসা বিষয়ে নবীয়ে কারীম ( সা.) যা বলেছেন, তা অবশ্যই ডাক্তার হিসেবে বলেননি। প্রিয়নবী সা. যদি ডাক্তারের ভুমিকায় অবতীর্ণ হতেন আর সেটা নবুওতের দাবী হতো,তাহলে তাঁর জন্য জরুরি ছিলো কিয়ামত পর্যন্ত চিকিৎসা বিষয়ক সকল সমস্যার তত্তীয় ও ব্যবহারিক সকল সমাধান পেশ করা।
বিজ্ঞানজাত যেসব বিষয় কুরঅান – সুন্নাহে এসেছে,তা এসেছে হেদায়েত ও নসীহার অংশ হিসেবে, সমাজ ও মানুষের চাহিদার অনিবার্যতায়। মানে, বিষয়টা তখন পেশ করা ছিলো বাস্তবতার দাবি,দ্বীনের দাবি।বিজ্ঞানের দাবিতে কিংবা বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত সবাইকে জানানোর উদ্দেশ্যে কুরঅান – হাদীসের একটি হরফও ব্যবহৃত হয়নি। কিন্তু যা বর্ণিত হয়েছে,তার ভিত্তিতে এ দাবি অন্যায্য যে, বিজ্ঞানের সকল কিছু কুরআন – হাদীসে আছে।
ঐতিহাসিক নানা প্রসঙ্গ কুরআন – হাদীসে এসেছে,যতটুকু হেদায়েতের জন্য দরকার,ঠিক ততটুকু এসেছে। আমরা এই আসাটাকে ভিত্তি করে দাবি করতে পারি না যে, ইতিহাসের সকল কিছু কুরঅান – হাদীসে বিদ্যমান! এ দাবি কুরআন – হাদীস সম্পর্কে ভুল বুঝা নির্দেশ করে, ইতিহাসসম্পর্কে অজ্ঞতারও জানান দেয়!
আলোচনাকে সামনে এগিয়ে নিতে চাই। এজন্য ভুল ধারণা ঝেড়ে ফেলতে হবে শুরুতে। এই দাবি ত্যাগ করতে হবে যে,বিজ্ঞানের সবই ইসলামে আছে কিংবা বিজ্ঞানকে শাসন করবে ইসলাম। এ দাবি নিয়ে এককদম সামনে এগুলে চারদিক থেকে সমস্যাই জন্ম নেবে কেবল। ইউরোপে ক্যাথলিক গীর্জা চেয়েছিলো খ্রিস্টধর্মের নামে বিজ্ঞানকে শাসন করবে! দাবি ছিলো, বাইবেলে আছে সব বিজ্ঞান। পোপতন্ত্র বিজ্ঞানীদের শায়েস্তা করার মূর্খতা শুরু করলো। এর পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। বিজ্ঞান জিতেছে। পরাক্রম লাভ করেছে সেক্যুলারিজম। খ্রিস্টধর্মকে হাত- পা বেঁধে জীবন ও জগতের বৃহত্তর ময়দান থেকে নির্বাসিত করে একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে বন্দি করা হয়েছে।
কিন্তু ইসলাম কখনোই বিজ্ঞান- গবেষণার পথরোধ করে দাঁড়ায়নি। নিত্য- নতুন আবিষ্কার ও গবেষণাকে ইসলাম স্বাগত জানিয়েছে। যখনই কোনো বৈজ্ঞানিক সত্য সামনে এসেছে, ইসলাম তার প্রতিপক্ষে যায়নি।বরং জীবন ও জগত সম্পর্কিত ভুল ধারণা থেকে বের হয়ে শুদ্ধ ধারণায় উপনীত হবার জন্য গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করেছে প্রতিনিয়ত। ফলত আকিদার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বিষয়ে একে অন্যকে কাফির বলার নজির মুসলিম ইতিহাসে থাকলেও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কারণে কাউকে কখনোই কাফির বলা হয়নি,আঘাত করা হয়নি। যখন অধিকতর গ্রহণযোগ্য বৈজ্ঞানিক থিউরি সামনে এসেছে, ইসলামের মনীষীরা তাকে মেনে নিয়েছেন,স্বাগত জানিয়েছেন। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহ. তাফসীরে কবিরে দেখিয়েছেন এমন বহু নমুনা, যা প্রমাণ করে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক সত্য মেনে নিতে ইসলামের মনীষীরা কীভাবে প্রস্তুত ছিলেন!
রাযী দেখিয়েছেন, প্রাচীন মুফাসসিরগণ মনে করতেন, আকাশে একটি সমুদ্র আছে।মেঘ সেখান থেকে আনে পানি,ঘটায় বৃষ্টিপাত। তারা মনে করতেন,সূর্য দিন শেষে ডুবে যায় একটি জলাশয়ে, যা কানায় কানায় ভরা।তাদের ধারণা ছিলো পৃথিবী গোলাকার নয়,সমতল।
তখনকার দুনিয়ায় এসব ধারণাই ছিলো অগ্রসর ধারণা। তাফসিরকাররা এগুলোর পক্ষে বক্তব্য রাখতেন।কুরআনের ভাষা থেকেই এগুলো প্রমাণের চেষ্টা চালাতেন। গ্রিক কিংবা খ্রিস্টান উত্তরাধিকার থেকে এগুলো এসেছিলো। মনে করা হতো হৃৎপিণ্ডে রক্ত চলাচল করে না।পৃথিবী ও জ্যোতির্মণ্ডলে গতির নিয়ম ভিন্ন ইত্যাদি। কিন্তু আব্বাসী আমলে এসব ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার।
ইসায়ী নবম শতাব্দীতেই মুসলিম বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন, পৃথিবী গোল,বর্তুলাকার। সমতল নয়। আল বেরুনি এসে এ মতামতকে দেন পরিপূর্ণতা। দশম শতকের অধিকাংশ মুফাসসির এ মতামতকে মেনে নেন। পুরনো মতামতের পক্ষে জেদ ধরেননি। কারণ এটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়। বিজ্ঞান যেহেতু গোলাকার তত্ত্বকে প্রমাণ করেছে, এখানে ধর্মের নামে বলার কিছু নেই। ইসলাম বরং এখানে ভুলকে ত্যাগ করে সঠিকতাকে অবলম্বন করারই নির্দেশনা দেয়।
লেখক : কবি, চিন্তক ও দার্শনিক, সিলেট।
( চলমান)
ট্যাগস

বানিয়াচংয়ে হবিগঞ্জ শিক্ষা-সংস্কৃতি উন্নয়ন পরিষদের উদ্যোগে মেধাবৃত্তি পরীক্ষা-২০২৩ অনুষ্ঠিত

বিজ্ঞানকে কোন নজরে দেখে ইসলাম

আপডেট সময় ০৮:০৫:১৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ জুলাই ২০২০
মুসা আল হাফিজ :
বিজ্ঞান ও ইসলামে বিরোধ কেন নেই, সেটা অনেকেই বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু বুঝতে না পারা ও না চাওয়াদের সংখ্যা কম নয়। এক ‘মাওলানা’ কমেন্ট করেছেন -” বিজ্ঞানে যা আছে,সবই ইসলামে আছে। একটি থেকে আরেকটি আলাদা নয়। বিজ্ঞানের যা কিছু ইসলাম সমর্থন করে, তা চলবে, যা ইসলাম সমর্থন করে না, তা চলতে পারে না।”
কমেন্টটি অজ্ঞতাজাত হলেও এ মানসিকতা লালন করেন হাজার হাজার মানুষ। ফলে বিষয়টা খোলাসা করতে চাইছি।
বিজ্ঞানের সকল সমাধান ইসলামে আছে, মনে করাটা ইসলাম সম্পর্কে ভুল বুঝার ফসল। নবুওতের কাজ স্বরূপ এবং নবীদের মিশন কী ও কেন, সেটা পরিষ্কার না থাকলে এ সমস্যা থাকবেই। সেটা বুঝার জন্য শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর রহ. বয়ান শোনা যেতে পারে।
হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায় তার ভাষ্য- যে বিষয়গুলোর সাথে চারিত্রিক পরিশুদ্ধির সম্পর্ক নেই কিংবা যে বিষয়গুলো জাতীয় রাজনীতি থেকে আলাদা, সেগুলোর প্রতি নবীগণ মোটেও ভ্রুক্ষেপ করেন না। যেমন বৃষ্টির কারণ ও প্রকৃতি, সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের কার্যকারণ, রঙধনু সৃষ্টির কারণ,বৃক্ষ ও প্রাণিজগতের রহস্য, চাঁদের গতি ও সূর্যের পরিক্রমা, নিত্যকার ঘটনাপ্রবাহের কারণ,নবী কিংবা রাজা – শাসকদের ইতিহাস, বিভিন্ন নগর- জনপদের ইতিকথা ইত্যাদি নিয়ে নবীগণ চিন্তা- ভাবনা করেন না। তবে এসবের যা কিছু জনপ্রিয় হয় এবং মানুষের বিবেক যাকে কবুল করে নেয়, তখন নবীগণও পরোক্ষভাবে সেগুলোর উল্লেখ করেন আল্লাহর মহিমা বর্ণনার নিমিত্তে। সেগুলোর মর্মকে ব্যক্ত করেন রূপকার্থে। এ কারণেই জনগণ যখন চাঁদের হ্রাস- বৃদ্ধি সম্পর্কে আল্লাহর রাসূলকে ( সা.) প্রশ্ন করলো, তখন তার পক্ষ থেকে আল্লাহ পাক সরাসরি এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বর্ণনা করলেন চাঁদের হ্রাস- বৃদ্ধির ফলে দিন- রাত নির্ধারণের উপকারিতার কথা। বলেন- তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করছে চাঁদ সম্পর্কে। হে রাসূল! বলে দিন, চাঁদ মানুষের জন্য নির্ধারণ করে সময়, নিরূপণ করে হজ্বের কাল।”
শিবলী নোমানী রহ. শাহ ওয়ালিউল্লাহ এর বক্তব্য উল্লেখ করে মন্তব্য করেন,- ‘নবীদের শিক্ষা ও নীতি সম্পর্কে তিনি যে বর্ণনা পেশ করলেন, এরপর কে বলতে পারে, বিজ্ঞান ও আধুনিক জ্ঞানের কারণে ধর্মের ক্ষতি হবার ভয়?’
আমি এখানে যোগ করতে চাই আরেকটি বিশেষ দিক।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ এখানে যা বলেছেন,এটা নবীদের মিশন তথা ইসলাম বনাম বিজ্ঞান সম্পর্কে মৌলিক বক্তব্য। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের যে সব বিষয় আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের, নবীগণ সেটা শেখাতে আসেন না। এগুলো তাদের লক্ষ্য ও মিশনের অন্তর্ভুক্ত নয়। বৈজ্ঞানিক ব্যাপারাদি পর্যবেক্ষণযোগ্য। এগুলো নিয়ে চিন্তাশীল যে কোন জ্ঞানী প্রজ্ঞা ও গবেষণাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে সমাধানে পৌছাতে পারে। কিন্তু নবীদের কাজ মানুষের বিশ্বাস,মূল্যবোধ ও চরিত্র সংস্কার। তাঁরা এই সংস্কারের ফর্মুলা পেশ করেন। ধর্মে থাকে বিশ্বাস ও কর্মের পরিশুদ্ধির বীধিলিপি। বস্তুগত গবেষণা, যন্ত্রপাতি আবিষ্কার,গণিত ইত্যাদি শেখানোর জন্য কুরআন নাযিল হয়নি, দ্বীন আগমন করেনি। অতএব ইসলামের মধ্যে সকল বৈজ্ঞানিক সমাধান থাকবে,এটা আশা করাই ভুল। হাম,শ্বেত,প্লেগ,ক্যান্সার,এলার
্জি, সার্স,মার্স,কোভিড ৯ ইত্যাদি রোগের চরিত্র,প্রকৃতি বলে দেবে কুরঅান- সুন্নাহ, বাতলে দেবে চিকিৎসার নিয়ম! – এটা আশা করাই ভুল। কীভাবে বিমান বানাতে হবে, কীভাবে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে হবে,কীভাবে উপগ্রহ পাঠাতে হবে,এসবের ফর্মুলা শরীয়ত থেকে কামনা করাটা সোনা দিয়ে মাটির কলস বানানোর ইচ্ছের সমান!
তাহলে কি তিব্বে নবী বা নবীজীর সা. চিকিৎসা বিষয়ক হাদীস প্রমাণিত নয়? কুরআন- হাদীসে বৈজ্ঞানিক বিবিধ বিষয় আলোচিত নয়?
চিকিৎসা বিষয়ে নবীয়ে কারীম ( সা.) যা বলেছেন, তা অবশ্যই ডাক্তার হিসেবে বলেননি। প্রিয়নবী সা. যদি ডাক্তারের ভুমিকায় অবতীর্ণ হতেন আর সেটা নবুওতের দাবী হতো,তাহলে তাঁর জন্য জরুরি ছিলো কিয়ামত পর্যন্ত চিকিৎসা বিষয়ক সকল সমস্যার তত্তীয় ও ব্যবহারিক সকল সমাধান পেশ করা।
বিজ্ঞানজাত যেসব বিষয় কুরঅান – সুন্নাহে এসেছে,তা এসেছে হেদায়েত ও নসীহার অংশ হিসেবে, সমাজ ও মানুষের চাহিদার অনিবার্যতায়। মানে, বিষয়টা তখন পেশ করা ছিলো বাস্তবতার দাবি,দ্বীনের দাবি।বিজ্ঞানের দাবিতে কিংবা বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত সবাইকে জানানোর উদ্দেশ্যে কুরঅান – হাদীসের একটি হরফও ব্যবহৃত হয়নি। কিন্তু যা বর্ণিত হয়েছে,তার ভিত্তিতে এ দাবি অন্যায্য যে, বিজ্ঞানের সকল কিছু কুরআন – হাদীসে আছে।
ঐতিহাসিক নানা প্রসঙ্গ কুরআন – হাদীসে এসেছে,যতটুকু হেদায়েতের জন্য দরকার,ঠিক ততটুকু এসেছে। আমরা এই আসাটাকে ভিত্তি করে দাবি করতে পারি না যে, ইতিহাসের সকল কিছু কুরঅান – হাদীসে বিদ্যমান! এ দাবি কুরআন – হাদীস সম্পর্কে ভুল বুঝা নির্দেশ করে, ইতিহাসসম্পর্কে অজ্ঞতারও জানান দেয়!
আলোচনাকে সামনে এগিয়ে নিতে চাই। এজন্য ভুল ধারণা ঝেড়ে ফেলতে হবে শুরুতে। এই দাবি ত্যাগ করতে হবে যে,বিজ্ঞানের সবই ইসলামে আছে কিংবা বিজ্ঞানকে শাসন করবে ইসলাম। এ দাবি নিয়ে এককদম সামনে এগুলে চারদিক থেকে সমস্যাই জন্ম নেবে কেবল। ইউরোপে ক্যাথলিক গীর্জা চেয়েছিলো খ্রিস্টধর্মের নামে বিজ্ঞানকে শাসন করবে! দাবি ছিলো, বাইবেলে আছে সব বিজ্ঞান। পোপতন্ত্র বিজ্ঞানীদের শায়েস্তা করার মূর্খতা শুরু করলো। এর পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। বিজ্ঞান জিতেছে। পরাক্রম লাভ করেছে সেক্যুলারিজম। খ্রিস্টধর্মকে হাত- পা বেঁধে জীবন ও জগতের বৃহত্তর ময়দান থেকে নির্বাসিত করে একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে বন্দি করা হয়েছে।
কিন্তু ইসলাম কখনোই বিজ্ঞান- গবেষণার পথরোধ করে দাঁড়ায়নি। নিত্য- নতুন আবিষ্কার ও গবেষণাকে ইসলাম স্বাগত জানিয়েছে। যখনই কোনো বৈজ্ঞানিক সত্য সামনে এসেছে, ইসলাম তার প্রতিপক্ষে যায়নি।বরং জীবন ও জগত সম্পর্কিত ভুল ধারণা থেকে বের হয়ে শুদ্ধ ধারণায় উপনীত হবার জন্য গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করেছে প্রতিনিয়ত। ফলত আকিদার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বিষয়ে একে অন্যকে কাফির বলার নজির মুসলিম ইতিহাসে থাকলেও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কারণে কাউকে কখনোই কাফির বলা হয়নি,আঘাত করা হয়নি। যখন অধিকতর গ্রহণযোগ্য বৈজ্ঞানিক থিউরি সামনে এসেছে, ইসলামের মনীষীরা তাকে মেনে নিয়েছেন,স্বাগত জানিয়েছেন। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহ. তাফসীরে কবিরে দেখিয়েছেন এমন বহু নমুনা, যা প্রমাণ করে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক সত্য মেনে নিতে ইসলামের মনীষীরা কীভাবে প্রস্তুত ছিলেন!
রাযী দেখিয়েছেন, প্রাচীন মুফাসসিরগণ মনে করতেন, আকাশে একটি সমুদ্র আছে।মেঘ সেখান থেকে আনে পানি,ঘটায় বৃষ্টিপাত। তারা মনে করতেন,সূর্য দিন শেষে ডুবে যায় একটি জলাশয়ে, যা কানায় কানায় ভরা।তাদের ধারণা ছিলো পৃথিবী গোলাকার নয়,সমতল।
তখনকার দুনিয়ায় এসব ধারণাই ছিলো অগ্রসর ধারণা। তাফসিরকাররা এগুলোর পক্ষে বক্তব্য রাখতেন।কুরআনের ভাষা থেকেই এগুলো প্রমাণের চেষ্টা চালাতেন। গ্রিক কিংবা খ্রিস্টান উত্তরাধিকার থেকে এগুলো এসেছিলো। মনে করা হতো হৃৎপিণ্ডে রক্ত চলাচল করে না।পৃথিবী ও জ্যোতির্মণ্ডলে গতির নিয়ম ভিন্ন ইত্যাদি। কিন্তু আব্বাসী আমলে এসব ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার।
ইসায়ী নবম শতাব্দীতেই মুসলিম বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন, পৃথিবী গোল,বর্তুলাকার। সমতল নয়। আল বেরুনি এসে এ মতামতকে দেন পরিপূর্ণতা। দশম শতকের অধিকাংশ মুফাসসির এ মতামতকে মেনে নেন। পুরনো মতামতের পক্ষে জেদ ধরেননি। কারণ এটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়। বিজ্ঞান যেহেতু গোলাকার তত্ত্বকে প্রমাণ করেছে, এখানে ধর্মের নামে বলার কিছু নেই। ইসলাম বরং এখানে ভুলকে ত্যাগ করে সঠিকতাকে অবলম্বন করারই নির্দেশনা দেয়।
লেখক : কবি, চিন্তক ও দার্শনিক, সিলেট।
( চলমান)