স্টাফ রিপোর্টার : জগদীশপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও নবীগঞ্জের দিনারপুর উচ্চ বিদ্যালয় এবং জগদীশপুর জে সি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক কাজী আজিজুর রহমানের ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি জন্মেছিলেন অজপাড়া গায়ের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। কিন্তু নিজ কর্মগুণে উঠেছিলেন সাফল্যের শিখরে। অর্জন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি।
ছিলেন একাধারে শিক্ষক ও জনপ্রতিনিধি। অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তি সবই ছিল তার হাতের মুঠোয়। তবে ক্ষমতার এত কাছে থেকেও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। অর্থের মোহ তাকে কোনদিনই টানেনি। দুর্নীতির কালিমা লাগতে দেননি গায়ে। জীবনের ৭৫টি বসন্তই ব্যয় করেছেন জনসেবায়। ৪৫টি বছর কাটিয়েছেন মানুষ গড়ার কাজে। তৈরি করেছেন দেশের প্রতিথযশা সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা। তার হাতে গড়া হাজারো ছাত্র আজ সাফল্যের অনন্য নজির গড়ছেন পৃথিবীময়। ক্ষণজন্মা এই মানুষটির জন্ম ১৯৪১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর জেলার ধরমন্ডল গ্রামে। বাবা সিদ্দিকুর রহমান ছিলেন সংসারের প্রতি উদাসীন। ঘুরে বেড়াতেন দেশ-বিদেশ। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার প্রতি খেয়াল ছিল না। তাই চার ভাই-বোনের সবার বড় বাবা ছোটবেলায় চলে আসেন তার নানা বাড়িতে। হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার বেলঘর গ্রামে। নানা-নানির আদরেই বেড়ে উঠেন।
প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন জগদীশপুর সরকারি বিদ্যালয়ে। কিন্তু কৃষক নানার ছিল অভাবের সংসার। তাই পড়ালেখার পাশাপাশি নানার কৃষিকাজেও সহায়তা করতেন। তবে বাবার মেধার কাছে দারিদ্র্যতা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। প্রতি ক্লাসেই রাখেন মেধার স্বাক্ষর। কৃতিত্বের সঙ্গেই প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন জগদীশপুর জে সি উচ্চ বিদ্যালয়ে। পড়ালেখার জন্য নানার আলাদা ঘর না থাকায় থাকতেন চাচাতো নানাদের ঘরে। পালা করে নানাদের ঘরে থেকে পড়াশোনা করতেন। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় ছিলেন উজ্জ্বল। ফুটবল হাডুডু খেলায় ছিলেন সমান পারদর্শী। খেলেছেনও জেলা পর্যায়ে। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে পাস করেন মেট্রিকুলেশন (এসএসসি)। ১৯৬১ সালে তিনি যখন এসএসসি পাস করেন তখন ওই গ্রামে আর কেউ সে যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি।
এরপর ভর্তি হন হবিগঞ্জের বৃন্দাবন সরকারি কলেজে। জায়গীর থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৬৩ সালে ওই কলেজেই ভর্তি হন ডিগ্রিতে (বিকম)। একইসঙ্গে ধরতে হয় অভাবের সংসারের হাল। ফলে যোগ দেন চাকরিতে। শিক্ষকতা পেশা দিয়েই শুরু করেন কর্মজীবন। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের । বেতন ১২৪ টাকা। ২৪ টাকা নিজের খরচের জন্য রেখে বাকি টাকা পাঠিয়ে দিতেন বাড়িতে। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। সহজেই মিশে গিয়েছিলেন ওই এলাকার মানুষের সঙ্গে। জড়িয়ে পড়েছিলেন আত্মীয়তার বন্ধনে। গজনাইপুর গ্রামের মমতাময়ী এক মা তাকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। দিয়েছিলেন ছেলের স্বীকৃতি। এরপর কিছুদিনের মধ্যে শিক্ষকতার পাশাপাশি জড়িয়ে পড়েন এলাকার রাজনীতিতে। নিয়মিত সালিশ-বিচারে অংশ নিতেন। স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। চাকরির পাশাপাশি নিজের পড়ালেখাটা সম্পন্ন করেন। ‘৭০ সালের নির্বাচনে ভোট দিয়ে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান জন্মদাত্রী মা। অকালে মাকে হারানোটা সহজে মেনে নিতে পারেননি। অভিমানে বিয়ে করতে অনীহা প্রকাশ করেন। এরপর দীর্ঘদিন গ্রামের বাড়িতে আসেননি। থাকতেন দিনারপুরে। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দিনারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প তৈরি করে। ওই স্কুলের বেঞ্চ ভেঙে রান্না-বান্নার কাজে ব্যবহার করতো হানাদাররা। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। পাক বাহিনী তাকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে বেধড়ক মারধর করে। এক পর্যায়ে তাকে হত্যার উদ্দেশে নিয়ে যায় গানপয়েন্টে। কিন্তু অপর এক পাঞ্জাবি অফিসারের সুমতিতে সেবার প্রাণে বেঁচে যান। স্বাধীনতার পর ফের ওই স্কুলে শিক্ষকতায় ফিরে যান। ৭৬-৭৭ সালের দিকে শিক্ষকতার পাশাপাশি শুরু করেন আইপিও (ইউরোপে লোক পাঠানো) ব্যবসা। তখন দুই হাতে অর্জন করে অর্থ। স্বাবলম্বী করেন পরিবারকে। কিন্তু ৭৮ সালের দিকে রাজধানীর নয়াপল্টন এলাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। সব কিছু খুইলেও দ্বিতীয় দফায় প্রাণে বেঁচে যান। এরপর দিন থেকে ওই ব্যবসা ছেড়ে দেন। শিক্ষকতায় মনোনিবেশ করেন। ৮০ সালে দাদার চাপাচাপিতে বিয়েতে সম্মতি দেন। ওই বছরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শাহবাজপুর গ্রামের সৈয়দা লতিফা বেগমের (আমার মা) বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর আরও তিন বছর ওই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ৮৩ সালের শেষের দিকে যোগ দেন হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার জগদীশপুর জে সি উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে। কিন্তু রাজনীতি তার রক্তে মিশেছিল।
নিজের এলাকায় শিক্ষকতার পাশাপাশি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তৎকালীন কৃষি প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মো. কায়সারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। মন্ত্রীর সঙ্গে অংশ নিতেন রাষ্ট্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। ওই বছরই জগদীশপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন। তবে অল্প ভোটে হেরে যান। ৮৮ সালে ফের ইউপি নির্বাচনে অংশ নেন। দ্বিতীয়বারে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সামান্য কৃষক পরিবারের ছেলেটি হয়ে উঠেন ওই এলাকার জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি। শিক্ষকতার পাশাপাশি সামাল দেন চেয়ারম্যানের দায়িত্বও। তৈরি করেন বেলঘর-খাটুরা গ্রামের আড়াই কিলোমিটার নতুন রাস্তাসহ বিভিন্ন গ্রামের কাচা-পাকা সড়ক। প্রতিষ্ঠা করেন বেশ কয়েকটি প্রাইমারি স্কুল। প্রতিদিন সকাল বেলা দেখতামÑ ওই ইউপির ১৩টি গ্রামের প্রায় অর্ধশত মানুষ বাড়িতে আসতো বুদ্ধি-পরামর্শ ও বিচার সালিশের জন্য। সবার সমস্যাই হাসিমুখে সমাধান করে দিতেন। ৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় আসা বিপুল পরিমাণ ত্রাণ দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করেন অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে। তৎকালীন কোটি কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ বণ্টন করে দেন ইউপি সদস্যদের। কোন ধরনের দুর্নীতি তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। পাঁচ বছর সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করেন। এত বছর রাজনীতি করেও একটি মামলার শিকার হননি। তবে পরের নির্বাচনে হেরে গেলে রাজনীতি থেকে অলিখিত অবসর নেন। তবে শিক্ষকতার সমাজসেবামূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন।
দীর্ঘদিন জগদীশপুর বাজার জামে মসজিদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একইসঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন মাধবপুর উপজেলা শিক্ষক সমিতির সদস্য, জগদীশপুর জে সি উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সদস্য, জগদীশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি, তেমুনিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতির, জগদীশপুর চা বাগানস্থ হযরত মানিক শাহ (রহ.)-এর মাজার কমিটির সভাপতির। ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে বিলেতপ্রবাসী এক ছাত্র তাকে লোভনীয় অফার দেন। কোটি টাকা ও বাড়ির সুযোগসহ লন্ডনে পাড়ি জমানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু ফিরিয়ে দেন সেই প্রস্তাব। জনসেবার মহান পেশা ছেড়ে যাননি তিনি। সারা জীবন পরোপকার করেছেন। গভীর রাত অবধি বিভিন্ন গ্রামের সালিশ করতেন। বিনিময়ে কোনদিন কারও কাছ থেকে কিছু নেননি। একটি ঘটনা বাবা বলেছিলেন স্বাধীনতার পর এলাকার পরিচিত এক লোককে গ্রেপ্তার করে অন্তরীণ করে পুলিশ। ওই ব্যক্তির স্বজনরা তাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য বাবার কাছে মিনতি করলেন। পরে নিজের গাঁটের তৎকালীন পাঁচশ’ টাকা দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনেন।
২০০৬ সালে শিক্ষকতার মহান পেশা থেকে অবসরে যান। তবে ওই পেশার মায়া তিনি ছাড়তে পারেননি। অবসরের পরও আরও দুই বছর খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ওই স্কুলে দায়িত্ব পালন করেন। প্রয়াত এই শিক্ষকের ৪র্থ মৃত্যু বার্ষিকীতে উনার পরিবারের পক্ষ থেকে সকলের কাছে দোয়া চাওয়া হয়েছে|