মুফতী মুহাম্মাদ আবিদুর রহমান::
রাহমাতে আলম ﷺ ভাবলেন, এই ফাঁকে একবার মক্কার বাইরে যাওয়া যাক। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তায়েফ যাবেন। তায়েফ; ফুলেফলে সুজলা সুফলা আর প্রাচুর্যে ভরপুর এক মনোরম নগরী। তায়েফের মানুষজন হয়ত মক্বার মানুষ থেকে কিছুটা সুন্দর ও মার্জিত হবে। তারা হয়ত সত্য কবুল করতে দেরি করবে না। এমনই এক সরল ভাবনায় বুকভরা আশা নিয়ে রাসুল ﷺ বেরিয়ে পড়লেন তায়েফের পথে। মক্কা থেকে তায়েফ দীর্ঘ ১২০ কিলোমিটার দূরত্বের পথ। সুদীর্ঘ যাত্রা পথে নবিজীর সহযাত্রী হলেন জায়েদ ইবনে হারেসা।
জায়েদ রাসুল ﷺ এর পালক পুত্র। ভাগ্য যাকে মুক্ত জীবন থেকে গোলামের জিঞ্জিরে বন্ধী করে রেখে ছিলো। তাকদির যাকে রাসুলের সুহবত ধন্যে ধন্য করেছিলো ফলে ভাগ্যের প্যাচে গোলাম হওয়া জায়েদ হয়ে ছিলো স্বাধীন জীবনের অধিকারী। গোলাম জায়েদকে আজাদ করে দিয়ে ছিলেন রাসুল ﷺ । পিতা হারিসা সন্তানের খুঁজ করতে করতে এক সময় মক্কায় এসে হাজির হয়। সন্তানকে নিয়ে যেতে চান বাবা হারিসা। কিন্তু জায়েদ পিতাকে বাদ দিয়ে রাসুলের আশ্রয়কেই বেচে নিয়ে ছিলেন। জায়েদ তখন সমজদার। নিজের ভালো মন্দের ফায়সালা নেবার জ্ঞান ছিলো তার। শেষতক বাবার সাথে ফিরে যায়নি। রসুল ﷺ ও জায়েদের এমনতর মহব্বতের কদর করে ছিলেন। গোলাম শ্রেণির মানুষকে যে সমাজে মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হত না সে সমাজে রাসুল ﷺ তাঁর গোলাম জায়েদকে শুধু আজাদই করেরনি কা’বা চত্বরে দাঁড়িয়ে নিজের সন্তান বলে ঘোষণা করেন।
সোয়াশ কিলোমিটার দূরের পায়ে চলা পথের সফরে পালকপুত্র জায়েদ তাঁর সফর সঙ্গী। রাসুল ﷺ ভাঙ্গা মন আর ব্যাথিত বদন টেনেটেনে ছুটে চলেছেন তায়েফের পথে। মাকসাদ একটাই ; তায়েফের মানুষগুলোকে দ্বীনের পথে এনে অনিবার্য ধংশের হাত থেকে বাঁচানো। তায়েফের নেতৃত্বে তখন বানু সাকিফ গোত্র। আব্দুল ইয়ালীল, মাসউদ ও হাবিব নামের তিন ভাই সেখানকার গুরুজন। সেই পরিবারের একজন ঘরণী কুরাইশ বংশের বানু জামুহ গোত্রের এক নারী। সম্পর্কের এই সুত্র ধরেই তায়েফের আব্দুল ইয়ালীল পরিবারে গিয়ে ওঠেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা ﷺ। বৈঠক ঘরে বসে তাদের সামনে পেশ করেন আপন পরিচয়। তোলে ধরেন মক্কার হাল হকিকত, নবুওয়তের বিষয়াদী এবং সব শেষে তাদের আহবান জানান তাঁকে রাসুল হিসেবে কবুল করার কথা। কথা শুনে তিন ভাই প্রতিক্রিয়া জানায় তিন কিসিমের।
প্রথমজন : কসম খোদার তুমি যদি নবি হয়ে থাকো তাহলে আমি আজই মক্কায় গিয়ে কা’বার চত্বরে আমার দাড়ি কেটে আসবো। অসম্ভব! আমি কিছুতেই তোমাকে নবি হিসেবে মানতে রাজি নই । দ্বিতীয়জন: মক্কা থেকে তায়েফে আসার জন্য একটা উঠ কিংবা ঘোড়া নাই যার সে দাবী করে নবি হওয়ার। নবি নির্বাচনের জন্য আল্লাহ বুঝি আর কোন মানুষ পেলেন না! যত্তসব!! তৃতীয়জন: আমি তোমার সাথে কোন কথাই বলবো না। কারন তুমি যদি সত্যই নবি হয়ে থাকো আর আমি তোমাকে না-মানি তবে তো আমার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। আর আদতে যদি নবি না হয়ে থাকো তাহলে তুমি তো একজন মিথ্যুক। আমি কোন মিথ্যাবাদীর সাথে কথা বলতে রাজি নই। কথাগুলো বলেই সেও ওঠে পড়লো। নবিজী ﷺ প্রচন্ড একটা হুচট খেলেন। বানু জামুহ গোত্রের সেই মহিলাকে বল্লেন; তোমার স্বামী গোত্র থেকে এমনটি আসা করিনি। শেষে নবিজী ﷺ তাদেরেকে বল্লেন; আচ্ছা আপনারা না হয় না মানলেন আপনাদের কাছে অনুরোধ থাকবে তায়েফে দ্বীন প্রচারে নিদেন পক্ষে আপনারা আমার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবেন না। আপনাদের অবস্থানও গোপন রাখার আবদার থাকলো।
কিন্তু নিবীজী ﷺ যখন তায়েফের পথে নামলেন দেখলেন এরা তাঁর কথা রাখেনি। এরা নীরব তো থাকলই না উল্টো তায়েফের বখাটে বাউন্ডুলে ছেলেদেরে নিবীজীর পেছনে লেলিয়ে দিলো। উশৃঙ্খল যুবকেরা পরবাসী দ্বীনের দায়ী রাহমাতে আলম ﷺ কে ইট পাটকেল মারতে মারতে তাড়াতে লাগলো। যাদের হেদায়াত কামনা করে, মুক্তির বার্তা নিয়ে, দ্বীন দুনিয়ার কল্যাণ কামনা করত: বুক ভরা আশা নিয়ে দীর্ঘ ১২০ কিলোমিটার দূর্গম পথ পায়ে হেটে এসেছেন সেই তারাই তাঁকে রক্তাক্ত করে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাঁর পবিত্র বদন মোবারক থেকে ঘামের মতো ঝরঝর করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তবু তিনি যতটা না শারিরিক ব্যাথা অনুভব করছেন এরচে’ ঢের বেশি ব্যাথিত হচ্ছেন দ্বীন কবুল না করে তারা চিরস্থায়ী বরবাদীর পথ এখতিয়ার করছে দেখে। হেদায়তকে গ্রহণ না করে তারা কুফরের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে দেখে। এক সময় শারিরিক ও মানসিক বিপর্যয়ের এই দখল তিনি আর টানতে পারলেন না। ক্লান্তিতে ঢলে পড়লেন। নবীজীর এমন অবস্থা দেখে জায়েদ রা. তাঁকে কাধে তোলে নিলেন।
তায়েফের বেরহম বাউন্ডুলে যুবকেরা তখনও তাদের তাড়া করছিলো। জায়েদ রাযি. নিবীজীকে ﷺ কাঁধে নিয়ে দ্রুত একটি বাগানের ভগ্ন দেয়ালের পেছনে আঙ্গুর তলায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন। নবীজীর উপর এমনতর অমানষিক নির্মম অত্যাচার আল্লাহ তায়ালা সহ্য করতে পারলেন না। তিনি জিবরিল আমিনকে বলে পাঠালেন; আমার হাবিবকে বলুন সে চাইলেই তায়েফের নিষ্টুর এই মানুষগুলোকে দুই পাহাড়ের মাঝখানে চাপা দিয়ে চির দিনের জন্য ধ্বংশ করে দেবো। শারিরিক মানসিক উভয় দিক থেকে চরমভাবে নির্যাতিত, নিপীরিত, নিষ্টুর আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত নবীজী ﷺ ক্ষতস্থান থেকে তখনও রক্ত ঝরছে তিনি বল্লেন, না, আমি তায়েফবাসীর ক্ষতি চাই না। আমার উপর করা তাদের জুলুমকে আমি ক্ষমা করে দিলাম। নবীজী ﷺ আরো বল্লেন; রাব্বি উম্মাতি উম্মাতি – প্রভু হে এরা আমার অবুজ উম্মত। আপনি এদের সুমতি দান করুন। আমি আশাবাদী আগামী দিনে এদের থেকেই জন্ম নিবে এমন একদল মানুষ যারা আপনার ইবাদত করবে। হে দয়াময় আল্লাহ! আপনি তাদেরে ধ্বংশ করে দিবেন না।