মোঃ শমশীর আহমদ : ক্ষমা বলা হয় কোন মানুষের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্বেও ক্ষমা করে দেওয়া। আমরা হলাম মানব সত্তা, আর মানব সত্তা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে একটি হল বিভিন্ন সময়ে ভুল করে থাকা, আর ভুলটা হতে পারে ২ ধরণের (১) ইচ্ছাকৃত ভুল (২) অনিচ্ছাকৃত ভুল। বিভিন্ন সময়ে নিজের অজান্তে ভুল করা মানব সত্তার সহজাত বৈশিষ্ট্য। আর ক্ষমা করা আল্লাহ তায়লার বিশেষ একটি গুণ। আমরা হলাম সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। সেই হিসাবে আমাদের উপর পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয়, রাষ্টীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে। সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে গিয়া আমরা বিভিন্ন সময় অনিচ্ছাকৃত ভুল করে থাকি। ইসলাম ধর্মে ২ ধরণের ক্ষমার কথা বর্ণিত আছে। (১) আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা, (২) মানুষের পক্ষ থেকে ক্ষমা। আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী বা তার সাথে সুসম্পর্ক স্হাপন করতে গিয়ে আমরা যে ভুল করে থাকি সেই ভুলের জন্য যদি মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, তাহলে আল্লাহ চাইলে আমাদেরকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। আর যদি কোন মানুষের কাছে কোন অন্যায়/জুলুম বা কারো হক্ব নষ্ট করে থাকি তাহলে সে ( নির্যাতিত ব্যক্তি) যতক্ষণ পর্যন্ত অপরাধ ক্ষমা না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত সেই অপরাধ ক্ষমা হবে না। ক্ষমা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেনঃ فَمَنْ تَابَ مِنْۢ بَعْدِ ظُلْمِهٖ وَاَصْلَحَ فان الله يتوب وعليه ان الله غفور رحيم. অর্থঃ কোন ব্যক্তি সীমালংঘন/ অন্যায় কাজ করার পর তওবা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে, তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন, নিশ্চয় ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। একবার রাসুল (সাঃ) এক ইহুদির কাছ থেকে নির্ধারিত তারিখে পরিশোধ করার শর্তে কিছু ধার এনে ছিলেন। পরবর্তীতে ঐ ইহুদি নির্ধারিত তারিখ আসার আগেই রাসুল (সাঃ) এর কাছে এসে জামা খামছিয়ে ধরে বলতে লাগল, হে মুহাম্মদ তুমি ও তুমার বংশ টালবাহানাকারী, তুমি আমার পাওনা পরিশোধ কর না কেন? সেই সাথে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে লাগল। তখন হযরত ওমর (রাঃ) চোঁখের সামনে রাসুলের সাথে খারাপ ব্যবহার দেখে তা বরদাশত্ করতে না পেরে রাসুল (সাঃ) কে বললেন ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনি যদি আমাকে অনুমুতি দেন তাহলে আমি ঐ মুনাফিককে হত্যা করে দিব ? তখন রাসুল (সাঃ) বললেন, হে উমর (রাঃ) তুমি তাকে ধমক দিওনা বরং তুমার জন্য উচিৎ ছিল, তার পাওনা পরিশোধ করার জন্য আমাকে উৎসাহিত করা। যাও তার পাওনা পরিশোধ করে দাও আর তুমি যেহেতু তার সাথে দুর্ব্যবহার করেছ এজন্য তার বদলা হিসাবে তার পাওনা থেকে আর কিছু অতিরিক্ত দিয়ে দাও। অন্য একটি হাদিসে এসেছে একবার রাসুল (সাঃ) এর কাছে এক ইহুদি মেহমান হলে রাসুল (সাঃ) তাকে উন্নতমানে খাদ্য দিয়ে মেহমানদারী করালেন ঘটনাক্রমে ঐ রাত্রে খাদ্য তার বদ হজম হয়ে গেল। ফলে সে বিছানায় পায়খানা করে দিয়েছে। তখন সে ভয় পেয়ে রাসুল (সাঃ) ঘুম থেকে উঠার আগেই রাসুল (সাঃ) কে না জানিয়েই চলে গেল। যাওয়ার সময় সে ভুলবশত তলোয়ার ফেলে গেল পর্বর্তীতে সে তলোয়ার নেওয়ার জন্য আসলে সাহাবায়ে কেরাম উত্তেজিত হয়ে বললেন, হে রাসুলাল্লাহ আমরা ঐ ইহুদিকে যেখানেই পাব সেখানেই হত্যা করব, তখন রাসুল (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামকে সান্তনা দিতেছেন এবং রাসুল (সাঃ) নিজ হাতে ময়লা পরিস্কার করতে লাগলেন। এ দিকে ইহুদি ঐ দৃশ্য দেখে কালিমা পড়ে মসলমান হয়ে গেল। রাসুল ( সাঃ) শত্রুদের প্রতি ছিলেন সর্বাধিক ক্ষমাশীল ও দয়ালু। রাসুল (সাঃ) তায়েফের ময়দানে সত্য ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে যারা রাসূল (সাঃ) শরীর মোবারক থেকে রক্ত ঝড়িয়েছে, তাদের জন্যও কল্যাণের দোয়া করছেন। শুধু তাই নয় যখন তিনি মক্কা বিজয় করে বীরের বেশে প্রবেশ করলেন তখন তিনি শত্রুদের হাতের নাগালে পেয়েও যারা রাসুল (সাঃ) এবং সাহাবায়ে কেরামকে নানাভাবে অমানবিক নির্যাতন করেছে। যারা বছরের পর বছর রাসুলের সংগে যুদ্ধ করেছে তাদেরকেসহ সবার জন্য তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন এমনকি নবী করীম (সাঃ) এর চাঁচা হামযা (রাঃ) কলিজা চিবিয়ে ছিল যেই হিন্দাহ এবং ওয়াহশী যিনি হযরত হামযা (রা)কে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। কেননা ক্ষমা করা হল ইসলামের অন্যতম একটি আদর্শ। আর ওয়াহশীকে বলে দিয়েছেন তুমি কোন দিন আমার সামনে আসবে না, কারণ তোমাকে দেখলে আমার চাঁচা হামযা (রা) কথা স্মরণ হয়ে যায়। ফলে আমার অন্তরে যে ব্যাথা অনুভব হয় সেই ব্যাথা আমি সহ্য করতে পারি না। রাসুল (সাঃ)কে গালি দেওয়ার কারণে বিধর্মীকে ধাক্কাা দিয়া মাটিতে ফেলে দিয়ে বুকের উপর বসে তলোয়ার হাতে নিলেন হযরত আলী ( রা.)। এবার তাকে হত্যা করবেন ঠিক সেই মুহুর্তে ঐ বিধর্মী আলী (রাঃ) মুখে থুথু মারলে সঙ্গে সঙ্গেই আলী (রাঃ) তাকে ছেড়ে দিলেন। তখন বিধর্মী আশ্চার্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল , আলী (রাঃ) তুমি কেন আমাকে ছেড়ে দিলে? তখন আলী (রাঃ) বললেন, শুন তুমি আমার মুখে থুথু ফেলার আগে তোমাকে হত্যার একমাত্র উদ্যেশ্য ছিল আল্লাহ ও রাসুলের ভালোবাসা, আর যখন তুমি আমার মুখে থুথু ফেলে দিলে তখন হয়ে গেছে আমার ব্যক্তি হিংসা। আর ব্যক্তি হিংসায় কোন মানুষকে হত্যা করা হারাম। কাজেই আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। রাসূল (সাঃ) এর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার ফলে ওয়াহশীসহ অনেক মূর্তিপুজারী, পৌত্তলিক ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহন করেছেন। ক্ষমার মাধ্যমে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধিপায়। তবে আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে ক্ষমা চাওয়ার অর্থ হলো নিজেকেও অনুতপ্ত করা, লজ্জিত করা, অন্যায়- অপরাধ মুলক কাজ বারবার না করা। যদি কেউ অপরাধমুলক কাজ বারবার করে তাহলে সেটা হবে সীমালংঘন। আর সীমলংঘনকারিকে মহান আল্লাহ পছন্দ করেন না। রাসূল (সাঃ) মক্কা বিজয়ের দিন সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেও কয়েক জনের ব্যাপারে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেননি। বরং তারা যেখানেই থাকে না কেন, তাদেরকে হত্যার নির্দেশ দিয়ে ছিলেন। আর আল্লাহ তা’য়ালা সকল অপরাধ ক্ষমা করলেও শিরিক নামক অপরাধ কখনও ক্ষমা করেন না। এখান থেকে আমাদের শিক্ষা হলো ক্ষমাযোগ্য অপরাধের একটি সীমা আছে এবং একটা ভুল যেন বারবার না করা হয়। আসুন আমরা ক্ষমার মাধ্যমে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে আদর্শ ও সুসৃংঙ্খল সমাজ গড়ার চেষ্টা করি। আমিন
লেখক : মাদ্রাসা শিক্ষক, বানিয়াচং।