তরঙ্গ ডেস্ক : হযরত সোলায়মান (আঃ) তাঁর সৈন্য-সামন্ত নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করে এক নতুন জায়গায় গিয়ে অবতরণ করলেন।
অবতরণ করা মাত্র তিনি শুনলেন পিপীলিকার রাজা চিৎকার করে বলছে, হে পিপীলিকার দল! তোমরা অতিসত্বর নিজ নিজ গর্তে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ কর, কারণ সোলায়মান (আঃ) তাঁর সৈন্য-সামন্ত নিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছেন। তাঁর সৈন্য অলক্ষে হয়ত তোমাদেরকে পিষে মারবে।
হযরত সোলায়মান (আঃ) পিপীলিকার কথা শুনে হাসলেন এবং বললেন, ক্ষুদ্র প্রাণি পিপীলিকার রাজা এতটা সতর্ক এবং দয়াবান তা আমি কোনদিন ভাবিনি। তিনি তখন পিপীলিকার রাজাকে হাতে তুলে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তোমার প্রজাবৃন্দের প্রতি এতটা মেহেরবান কেন এবং আমার সম্পর্কে যে উক্তি করেছো তাতে মনে হয় আমি প্রাণীকুলের উপর জুলুম করে থাকি। আমার উপর এভাবে কেন দোষারোপ করলে?
পিপীলিকার রাজা তখন উত্তর দিল, হে আল্লাহর খলিফা! আপনি আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠ নবীদের একজন। আপনার দায়িত্ব অনেক বড়। আমরা অত্যান্ত ক্ষুদ্র প্রাণী। আমাদের দায়িত্বও ক্ষুদ্র। আল্লাহতায়ালা আমার উপর প্রজাদের ভাল-মন্দ দেখা শুনার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। সে হিসেবে তাদের সুখে আমি সুখি হই এবং তাদের দুঃখে আমি অস্থির হয়ে পড়ি। এজন্য আপনার সৈন্যদের আগমন এবং তাদের অর্শ্ব চালনার সময় বেখেয়ালে আমার প্রজাবৃন্দ পদদলিত হতে পারে। এ আশঙ্কায় আমি তাদেরকে সর্তক করে দিয়েছি। দ্বিতীয় আপনাকে জালেম বলার ধৃষ্টতা আমার মাঝে আদৌ নেই। শুধু আপনার সৈন্যদের বেপরোয়া অশ্ব চালনার বিষয়ে আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম। ক্ষুদ্র প্রাণীদের বড় প্রাণীরা কোন পরোয়া করে না।
হযরত সোলায়মান (আঃ) বললেন, তোমার কথা শুনে আমি খুশি হয়েছি। এখন বলতো তোমাদের পিপীলিকাদের সৈন্য সংখ্যা কত?
পিপীলিকার রাজা উত্তর দিল, পিপীলিকাদের প্রধান সেনাপতির সংখ্যা চল্লিশ হাজার। প্রত্যেক সেনাপতির অধিনে চল্লিশ হাজার সুবেদার। প্রত্যেক সুবেদারের অধিনে রয়েছে চল্লিশ হাজার হাকিম। প্রত্যেক হাকিমের অধিনে রয়েছে চল্লিশ হাজার ফৌজদার।
হযরত সোলায়মান (আঃ) এ পর্যন্ত শুনে বলেলন, আচ্ছা বুঝেছি সৈন্য সংখ্যা বিরাট। এখন বল তোমার রাজ্য ভালো? না আমার রাজ্য ভালো?
পিপীলিকার রাজা বলল, আমার রাজ্য আপনার রাজ্যের চাইতে ভালো। কারণ জ্বীন দ্বারা আপনার সিংহাসন তৈরি। ইহা বাতাসের সাহায্যে পরিচালানা করছেন। এতে বুঝা যাচ্ছে আপনি পর নির্ভরশীল আর আমার কোন সিংহাসন নেই। তাই কারো উপর ক্ষণিকের জন্যও আমাকে নির্ভর করতে হয় না।
হযরত সোলায়মান (আঃ) পিপীলিকার কথা শুনে বললেন, তোমার মাথায় এত বুদ্ধি, তোমার কথায় এত যুক্তি। এ সমস্ত তুমি কোথায় শিখলে?
পিপঁড়াদের রাজা বলল, হে আল্লাহর নবী! যে মহান আল্লাহতায়ালা আপনাকে বিশাল রাজ্য ও অশেষ বিদ্যা এবং জ্ঞান বিজ্ঞান দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, সে মহান আল্লাহতায়ালা আমার প্রাপ্য জ্ঞান ও বিদ্যা আমাকেও দান করেছেন।
হযরত সোলায়মান (আঃ) বললেন, তুমি অনেক জ্ঞানের অধিকারী। অতএব, তুমি আমার রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে ভুল-ত্রুটি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা কর।
পিপীলিকা-রাজ তখন বলল, হে আল্লাহর খলিফা! আপনার রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে ভুল ত্রুটি আলোচনা করা আমার জন্য বেয়াদবি। তবে আপনি যখন আমাকে সু্যোগ দিয়েছেন, সে হিসেবে সমালোচনার উদ্দেশ্যে নয় বরং আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে পারি। আপনি আল্লাহতায়ালার দরবারে রাজ্যলাভের জন্য দোয়া করেছিলেন। হে প্রভু! আমাকে এমন এক সুন্দর বৃহৎ রাজ্য দান কর যার উপযোগী একমাত্র আমি থাকব। আমার পরে যেন কেউ আর এ ধরনের রাজ্য অধিপতি না হতে পারে। তুমি মহান দাতা। হে আল্লাহর খলিফা! এ ধরনের এক ঈর্ষামূলক দোয়া করা আপনার ন্যায় একজন পয়গম্বরের পক্ষে কতদূর সমীচিন হয়েছে তা জানি না। কথাটি যে ঈর্ষামূলক তাতে সন্দেহ নেই। আপনাকে আল্লাহ বিশাল রাজ্যের অধিপতি করেছেন। জ্বীন-পরী, আগুন, বাতাসকে আপনার বাধ্য করে দিয়েছেন। এটা অত্যন্ত আনন্দের কথা। আপনার পরে আল্লাহ যদি আরো কয়েকজনকে এরূপ বিশাল রাজ্যের অধিপতি করেন তাতে আপত্তি কেন? এ আপত্তি দ্বারা কি প্রমাণিত হয়। তা আপনি একবার ভেবে দেখুন। একজন নবীর পক্ষে এধরণের ব্যক্তিগত স্বার্থ সম্বলিত দোয়া খুবই বেমানান।
হযরত সোলায়মান (আঃ) পিপীলিকা-রাজের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার বাকশক্তি রোধ হয়ে গেল। তিনি এ সমস্ত কথার কোন জবাব দিতে আর সক্ষম হলেন না। শুধু এতটুকু বললেন, ভাই পিপীলিকা-রাজ তোমার দৃষ্টিতে আমার আর কি ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে তা আমাকে বলে দাও।
পিপীলিকা রাজ বলল, আমার কথায় আপনি একটু বেজার হয়েছেন বটে। তবে আপনাকে উচিত কথা বলার ওয়াদা দিয়েছি, তাই আমাকে কথাগুলো বলতে হবে। আপনাকে আল্লাহতায়ালা যে বেহেশতি আংটি দান করেছেন, তার বরকতে আপনি পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত সমগ্র পৃথিবীর উপর রাজত্ব করে যাচ্ছেন। জ্বীন, মানব, পশু-পক্ষী, আগুন ও বাতাসের ওপর প্রভুত্বের অধিকারলাভ করেছেন। বিশাল রাজত্ব ও নবুয়তি দুটি সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মানের অধিকারী হয়েছেন। এগুলো সম্পূর্ণ আংটির বদৌলতে আপনি লাভ করেছেন। আপনার ব্যক্তিগত কোন যোগ্যতায় এ সমস্ত আপনি লাভ করেন নাই। সবই আল্লাহতায়ালার প্রদত্ত। সেই আংটির মহাত্ম ও বরকত লাভ করেছেন। যদি এই আংটি আপনার হাত থেকে নিয়ে নেয়া হয় তখন আপনার এই প্রভুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব কিছুই থাকবে না। অতএব সে সময়ের কথা স্মরণ করে আল্লাহর দরবারে যে পরিমান শোকর-গুজারি করা উচিৎ তা সম্পূর্ণ হচ্ছে না।
এরপরে বাতাসকে আল্লাহতায়ালার আপনার অধিন করে দেওয়ার তাৎপর্য হল বাতাস দেখা যায় না, ধরা যায় না, শুধু তার অস্থিত্ব অনুভব করা যায় মাত্র। এভাবে এক আকৃতিবিহীন শক্তিকে আপনার অধীন করে দেওয়ার মাধ্যমে আপনাকে এ শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে যে, সমস্ত শক্তি, দাম্ভিকতা ও জৌলুসের বড়াই ভিত্তিহীন। সব কিছুর মূল অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে সবকিছু আকৃতি বিহীন, বাতাস সমতুল্য, মৃত্যুর পর পার্থিব সব কিছুকে বাতাসের ন্যায় মনে হবে। কিছু দেখা যাবে না, স্পর্শ করা যাবে না শুধু অনুভব করা যাবে মাত্র।
হযরত সোলায়মান (আঃ) পিপীলিকা-রাজকে মাটিতে রেখে নিজ পথ চলতে আরম্ভ করলেন। তখন পিপীলিকা-রাজ বলল, হে আল্লাহর খলিফা, আপনি গরীবদের কাছে এসে খালিমুখে যাবেন, তা হয় না। আপনি দয়া করে কিছু খেয়ে যান। হযরত সোলায়মান (আঃ) কথা শুনে দাড়ালেন। তখন পিঁপড়ারাজ তার লস্করদেরকে নাস্তা দেবার জন্য হুকুম দিল। তারা একখানা ভাজা ফড়িং-এর ঠ্যাং এনে দিল। হযরত সোলায়মান (আঃ) তা দেখে একটু হাসলেন।
পিপীলিকারাজ তখন বলল, আপনি হাসছেন কেন? ক্ষুদ্র খাদ্য দ্রব্য অনেক সময় বরকতপূর্ণ হয়ে অনেক মানুষকে পরিতৃপ্তি দান করতে পারে। আর বিশাল খাদ্যস্তুপ অনেক সময় শুধু একটি মাছের খাদ্য হিসাবে যথেষ্ট হয় না। এগুলো সব আল্লাহতায়ালার নিয়ন্ত্রণাধীন বিষয়। অতএব, আপনি লোকজনসহ বিসমিল্লাহ বলে মুখে দিন। আল্লাহ এতেই বরকত দান করবেন। হযরত সোলায়মান (আঃ) ফড়িং-এর ঠ্যাং থেকে একটু সামান্য অংশ নিয়ে মুখে দিলেন। তিনি অনুভব করলেন, এই বিচ্ছিন্ন অংশটি অনেক বড় হয়ে তার হাতে উঠেছে। মুখে দিলেন আর বড় আকার ধারণ করছে। যখন তিনি গিলে ফেললেন, তখন তাঁর পেট পরিপূর্ণ হয়ে গেল। তিনি তাঁর সঙ্গীদের একটু একটু অংশ নিয়ে খেতে বললেন। সকলেই এক চিমটি করে কাবাব খেয়ে পরিতৃপ্ত হলেন। দ্বিতীয় বার আর কেউ সামান্য খেতে উদ্দত হল না। কয়েক হাজার মানুষ এভাবে খাবার কাজ সমাধান করল। তাতে দেখা গেল ভাজা ফড়িং-এর ঠ্যাং এক চতুর্থাংশ মাত্র শেষ হয়েছে।
আল্লাহর বরকতময় রিজিক অল্প হলেও যথেষ্ট। ইদানিং দেখা যায়, বিশ্বাসের প্রত্যয় এত দুর্বল হয়েছে যে, উচ্ছিষ্ট খাবারে মুখ লাগিয়ে মানুষ বসে থাকে। অথচ….
” বাঘ না খেয়ে মরলেও
কুকুর মতো উচ্ছিষ্ট মুখে তুলে না।”
সূত্র : ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত