শামীম আহছান :
হাসান শাহরিয়ার প্রতি দৈনিক খোয়াই এর শ্রদ্ধা…. কি করে শুরু করব জানি না। শাহরিয়ার ভাইকে নিয়ে কি লিখব তাও বুঝতে পারছি না। মর্মান্তিক খবরটি পাওয়ার পর থেকে তাঁর মায়াভরা মুখখানি বার বার ভেসে উঠছে। আমার সাংবাদিক ও ব্যক্তি জীবনে শাহারিয়ার ভাইয়ের স্পর্শ ভূলার মতো নয়। কত স্মৃতি, কত ঘটনা, কথা কথা তাঁর সঙ্গে। সব মনে পড়ছে। তাঁর কাছ থেকে তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের অনেক গল্প শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধী, ভুট্টো, জিয়াউল হক, মাদার তেরেসার স্বাক্ষাৎকার নিয়ে তাঁর কাছ থেকে অবিস্মরণীয় ঘটনা শুনেছিলাম। এছাড়া বিশ্বের আরও অনেক উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর স্মৃতি শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল।
দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চমকপ্রদ সব ঘটনা জেনে আশ্চার্য্য হতাম। যেগুলো কখনই প্রকাশ হয়নি কোন মিডিয়ায়। অনেক ভাল ভাল পদের আহবান পেয়েও যোগদান না করে শুধু সাংবাদিকতাই থেকে যাওয়া সৎ, কর্মঠ, একনিষ্ট সাংবাদিক হিসেবে জীবন পার করা একজন সহজ, সরল, ভদ্র, হাসি-খুঁশি মানুষ ছিলেন শাহরিয়ার ভাই। অসম্ভব আড্ডাবাজ শাহরিয়ার ভাইয়ের সঙ্গে রাতের পর রাত গল্প করে কাটিয়ে দেওয়া যেত। তাঁর দীর্ঘদিনের বসবাস ঢাকার মালিবাগে পাবনা কলোনির বাসায় সময় কাঠানো, ইত্তেফাকে থাকাকালীন সিলেট বিভাগের চারটি জেলার সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখার সময় আমাদের হবিগঞ্জের বাসায় সময় কাঠানোর কথা বার বার মনে পড়ছে।
একটি নিউজের ইন্ট্রো কেমন হবে তা তখন বার বার দেখেছি। তিনিও তখন ইন্ট্রো নিয়ে বার বার কাটাছেড়া করা, কাগজ ছিড়ে ফেলা, কয়েকবারের পর ইন্ট্রো চূড়ান্ত করার কথা মনে পড়ছে। এতবড় সাংবাদিক হয়েও কত সাধারণ সহজ ছিলেন তিনি। অথচ আমরা মফস্বলের সামাস্য সংবাদকর্মী হয়ে কত ভাবসাব, কত হাম্বরা। তাঁর কারণে মরহুম জগলুল ভাই, মানবজমিনের মতিউর রহমান চৌধুরী, পীর ফরিদ ভাই, নিউজ নেটওয়ার্কের শহীদ ভাই ইত্তেফাকের মরহুম গোলাম সারোয়ার তখনকার বিখ্যাত ফটোগ্রাফার আলম ভাই, আফতাব আহমেদসহ অনেকের সংম্পর্শে আসার আমার সৌভাগ্য হয়েছিল।
দৈনিক দেশ পত্রিকার নিজস্ব প্রতিনিধি হিসাবে তিনি আমায় সম্পাদক সানাউল্লাহ নূরীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। মফস্বল সম্পাদক যুবেরী ভাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। তিনি ছিলেন দেওয়ান আজরফের ছেলে। ১৯৭৭ সনে আমার সাংবাদিকতা শুরু হয়েছিল। তখন থেকেই মূলত তার সংস্পর্শে আসা শুরু। তারপর ১৯৯১ সনে সাপ্তাহিক খোয়াইয়ের জন্ম থেকে তাঁর সংশ্লিষ্টতা আরও গভীর হয়। তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধু হবিগঞ্জের তৎকালীন পুলিশ সুপার জনাব নূর উদ্দিনের আন্তরিক চেষ্টায় সাপ্তাহিক খোয়াইয়ের অনুমোদন পাই। প্রকাশনার প্রথম থেকে কয়েক বছর তাঁর ঢাকার বাসায় তাঁর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ও পরামর্শে খোয়াইয়ের গেটআপ, শিরোনাম, নিউজ ট্রিটমেন্ট চলে নিয়মিভাবে। উদ্বোধনী সংখ্যা তাঁর ইত্তেফাকের অফিস কক্ষে সজ্জিত হয়েছিল।
মরহুম গোলাম সারোয়ারের সহযোগিতায় ইত্তেফাকের পেস্টার খোয়াইয়ের উদ্বোধনী সংখ্যা পেস্ট করেছিলেন। শাহরিয়ার ভাইয়ের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছিল। প্রতিটি নিউজ তিনি দেখে যেতেন ধৈর্য্য ধরে। খোয়াইয়ের একটি সংখ্যায় আমার ছবি ও নিউজ দেখে তিনি রাগ করে বলেছিলেনÑ তোমার নিউজ, ছবি দেখার জন্য পাঠক পত্রিকা কেন কিনবে। তিনি খোয়াইকে হবিগঞ্জের ইত্তেফাক বলতেন সবসময়।
তাঁর ঋণ কখনই শোধ হবার নয়। তাঁর বাসা থেকে কখনই না খেয়ে আসা যেত না। বিশেষ করে উনার বোন বেবী আপার আদর স্নেহ ভুলার নয়। উনার আম্মা যতদিন বেঁচে ছিলেন অনেক মায়া করেছেন। শাহরিয়ার ভাইয়ের বিয়ে কথা আমায় বার বার বলতেন। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি। শেষ পর্যন্ত এভাবেই তিনি আল্লাহর আহবানে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন।
তাঁর পিতা মকবুল হোসেন চৌধুরী তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁর অসান্য ভূমিকা ছিল। সিলেট রেফারেন্ডামেও তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। পিতার একজন যোগ্য উত্তরসূরী হিসাবে দেশ-বিদেশে শাহারিয়ার ভাই সুনাম কুড়িয়েছেন। সাংবাদিকতার উচ্চ শিখরে পৌঁছেও তাঁর মাঝে বিন্দুমাত্র অহমিকা ছিল না। সাদামাটা জীবন যাপন করে গেছেন আজীবন। হজ্ব-ওমরাহ আদায় করেছেন। মানুষের সাহায্যে এগিয়ে গেছেন সাধ্যমত। আল্লাহর তাঁর সকল ভাল কাজের জন্য বেহেশতে নসিব করুণ।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক খোয়াই, হবিগঞ্জ।