মো. মামুন চৌধুরী, হবিগঞ্জ থেকে : শিল্পবর্জ্যে দূষিত হয়েই চলেছে হবিগঞ্জের খাল ও নদীর পানি। ফলে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এখানের পরিবেশ।
এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশপ্রেমিকরা দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
জেলার মাধবপুর, শায়েস্তাগঞ্জ ও হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো বৃহৎ ও মাঝারি কলকারখানা। নূরপুর, ওলিপুর, শাহজীবাজার, নোয়াপাড়া, ছাতিয়াইন, জগদীশপুরসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে নদী-নালা ও খাল-বিলে ছড়িয়ে পড়ছে বর্জ্যদূষণ।
অন্যদিকে নতুন করে বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলাতেও শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। এসব কারখানার বর্জ্যের দূষণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন হবিগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কয়েক লাখ মানুষ। হুমকির মুখে পড়েছে এই এলাকার কৃষিজমি, খাল, ছড়া ও নদী।
বর্জ্য মেশানো পানি হবিগঞ্জের সুতাং নদী, খড়খির খাল, ইক্তিয়ারপুর খাল, শৈলজুড়া খাল, বেজুরাখাল ও হাওর হয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে বলভদ্র, কানাই, বাগাদা ও খাষ্টি নদীতেও ছড়াচ্ছে।
এসব এলাকায় তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত কালো ও দূষিত পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বাধ্য হয়ে লোকজন দুর্গন্ধময় ও দূষিত পানির সঙ্গে বসবাস করছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় অসংখ্য মানুষ মারাত্মক চর্মরোগ, শ্বাসকষ্টসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন। দেশীয় প্রজাতির মাছ হারিয়ে নদী, খাল-বিলগুলো প্রায় মৎস্যশূন্য হয়ে পড়েছে।
জানা যায়, ২০১৪ সালে কৃষিকাজে সেচ ব্যবস্থার নামে শৈলজুরা নামের খালটি পুনঃখনন করে কয়েকটি কারখানার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। ফলে এসব কারখানার বর্জ্য সহজেই খালের মাধ্যমে সুতাং নদীতে গড়াচ্ছে। ফলে ক্রমেই শিল্পবর্জ্য দূষণে সুতাং নদীর পানি অসহনীয় দুর্গন্ধ ও কালো কুচকুচে হয়ে পড়েছে। তাই নদীর পানি ব্যবহারকারীরা পড়েছেন বিপাকে।
এ ব্যাপারে আলাপকালে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ এর সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল জানান, হবিগঞ্জে প্রায় এক দশক ধরে শিল্পদূষণ চরম আকার ধারণ করেছে। যা ফসলের ক্ষতি, নিরাপদ পানির অভাবসহ চরম পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে।
তিনি বলেন, পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো চলমান বেপরোয়া ও অপরিকল্পিত শিল্পায়ন এবং পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয়ের কথা অনেক অনেকবার আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে পরিকল্পিত ও উৎসে বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু কেউই এ বিষয়ে কর্ণপাত করছেন না।
তিনি বলেন, অপরিকল্পিত শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার চলমান প্রক্রিয়া বন্ধ না হলে এখানে ব্যাপক পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটবে। ছড়িয়ে পড়া বর্জ্য দূষণ প্রতিরোধে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এর মাত্রা আয়ত্বের বাইরে চলে যেতে পারে।
বুল্লা নৌকা ঘাটের কাছে কথা হয় সুতাং নদী ব্যবহারকারী নয়াবাদ গ্রামের জয়নাল চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, কোম্পানির বিষাক্ত পানি নদীতে আসায় এখন গোসল করতে পারিনা, জমিতে সেচ দিতে পারিনা।
সুজাতপুর গ্রামের নীরদ দাস বুল্লা বাজারে এসেছিলেন বাঁশ কিনতে। তিনি বলেন, ২০ বছর ধরে এই সুতাং নদীতে নৌকা চালাই। বাজার সদাই করার জন্য এই নদী দিয়ে বুল্লা আসতাম। কিন্তু নদীর পানির দুর্গন্ধের জন্য এখন আর আগের মত আসা হয় না।
বেকিটেকা গ্রামের মো. সজিব আলী বলেন, আমাদেরকে দেখার মত কেউ নাই। কোম্পানির দূষিত পানিতে নদীটি এমন হয়েছে। নদীর পানি আমরা পান করতাম, মাছ ধরতাম। এখন মাছ ধরা তো দূরে থাক, দুর্গন্ধে বাড়িতেও বসবাস করা করা দায় হয়ে উঠেছে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় অফিসের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, নদীর পরিবেশ রক্ষায় তারা কাজ করছেন। বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তবে শিল্প ভালমন্দ দেখার জন্য কলকারখানা কর্তৃপক্ষ আছেন। জেলা প্রশাসন আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড রয়েছে।