শামীমুল হক :
দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ছবি তুলছিলেন, ভিডিও করছিলেন সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মোজাক্কির। গত শুক্রবার নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। চলে গুলি। সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন মোজাক্কির। এ দৃশ্য দেখে ফেলে কোনো পক্ষ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তাকে টার্গেট করে গুলি করা হয়েছিল। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আইসিইউতে নেয়া হয় তাকে। গত শনিবার ডাক্তাররা জানিয়েছিলেন তার অবস্থা অবনতির দিকে। রাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের তালিকায় নাম লেখায় মোজাক্কির।
দেশে খুনের তালিকায় যোগ হলো আরো এক সাংবাদিকের নাম। বোরহান উদ্দিন মোজাক্কির কোম্পানীগঞ্জের স্থানীয় সাংবাদিক। নোয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করে যোগ দিয়েছিলেন সাংবাদিকতায়। কিন্তু শুরু হতে না হতেই ঘাতকের বুলেট তার স্বপ্ন চুরমার করে দেয়। এইতো ক’দিন আগে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের ৯ বছর পেরিয়েছে। সেদিনও সাংবাদিকরা এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে রাজপথে দাঁড়িয়েছিল। দু’সপ্তাহ না পেরুতেই মোজাক্কির খুন হলো।সাংবাদিকরা সবসময় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। অথচ তাদের ওপর সবসময় কালো থাবা লেগেই থাকে। একটি হত্যাকাণ্ড ঘটলে সাংবাদিকরা কিছুদিন প্রতিবাদ করে। এতটুকুই।
মোজাক্কির হত্যায় সাংবাদিক সংগঠনগুলো এখনো কোনো বিবৃতি দেয়নি। হয়তো বিবৃতি আসবে। কিন্তু বিচার হবে কি? এমন আরো কত সাংবাদিক খুন হয়েছেন। তাদের পরিবার বিচারের আশায় দিন পার করছে। সাংবাদিক খুনের তালিকায় রয়েছেন- সাতক্ষীরার পত্রদূত সম্পাদক শ.ম আলাউদ্দীন। যশোরের দৈনিক রানার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল। দৈনিক জনকণ্ঠের যশোর প্রতিনিধি শামছুর রহমান কেবল। কেবলকে তার নিজ কার্যালয়ে সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে হত্যা করে। খুলনা প্রেস ক্লাবের সামনে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় নিহত হন দৈনিক সংবাদের খুলনা ব্যুরো প্রধান ও প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মানিক সাহা।
কেরানীগঞ্জে দি নিউএজের সাংবাদিক আবদুল লতিফ পাপ্পুও রয়েছে এ তালিকায়। নিজের অফিসে খুন হন খুলনার দৈনিক জন্মভূমির সম্পাদক হুমায়ূন কবির বালু। বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক দুর্জয় বাংলার নির্বাহী সম্পাদক দীপাংকর চক্রবর্তী নিজ বাসায় খুন হন। এ তালিকায় রয়েছেন দৈনিক সংগ্রামের খুলনা প্রতিনিধি বেলাল হোসেন। কুমিল্লার দৈনিক মুক্তকণ্ঠের রিপোর্টার গোলাম মাহমুদ। দৈনিক সমকালের ফরিদপুর ব্যুরো প্রধান গৌতম দাস। ঢাকায় খুন হন এনটিভির ভিডিও এডিটর আতিকুল ইসলাম আতিক। ঢাকার পাক্ষিক মুক্তমনের স্টাফ রিপোর্টার নূরুল ইসলাম ওরফে রানাও খুন হন। গাজীপুরে সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক সময়-এর নির্বাহী সম্পাদক এমএম আহসান হাবিব বারীও এ তালিকায় নাম লেখান। খুনের তালিকায় রয়েছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার সংবাদদাতা
ও রূপগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি আবুল হাসান আসিফ ২০১০ সালের ২৮শে এপ্রিল খুন হন বিশিষ্ট সাংবাদিক সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিলেট প্রতিনিধি ফতেহ ওসমানী। এ ছাড়া গুপ্তহত্যার শিকার হন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার সিনিয়র ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম টুটুল। প্রকাশ্যে খুন হন বরিশালের মুলাদী প্রেস ক্লাবের সভাপতি মনির হোসেন রাঢ়ী। পল্টনে নিজ বাসায় খুন হন প্রবীণ সাংবাদিক দৈনিক জনতার সহ-সম্পাদক ফরহাদ খাঁ ও তার স্ত্রী রহিমা খাতুন। চট্টগ্রামের পোর্টকলোনি এলাকায় দৈনিক আজকের প্রত্যাশা, সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র ও আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার সাংবাদিক মাহবুব টুটুলকে হত্যা করা হয়। একইদিন উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাসার বাসিন্দা সাপ্তাহিক বজ্রকণ্ঠের সাংবাদিক আলতাফ হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ কুকরাইল এলাকায় গলা কেটে হত্যা করা হয় দৈনিক ভোরের ডাকের গোবিন্দগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম রঞ্জুকে।
সাংবাদিকরা সমাজের প্রতিবিম্ব। তাদের ওপর আক্রোশ থেকে আক্রমণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। তারপরও সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন দিচ্ছেন। পরিবারকে অসহায় রেখে অকালে পাড়ি জমাচ্ছেন পরপারে। কিন্তু পরিবারগুলো স্বজন হত্যার বিচার পর্যন্ত পান না। মোজাক্কিরের ভাইও গত শনিবার রাতে ক্যামেরার সামনে কাঁদতে কাঁদতে ভাই হত্যার বিচার চেয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো-সাংবাদিক কেন সন্ত্রাসী চক্রের টার্গেট হচ্ছে? ২৫ বছর বয়সী মোজাক্কির কত স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন এ পেশায়। হয়তো সমাজ বদলের প্রতিজ্ঞা ছিল তার মনে। কিন্তু শুরুতেই শেষ করে দেয়া হলো তার স্বপ্নকে। শুধু সাংবাদিককে হত্যাই নয়। কত সাংবাদিক যে সন্ত্রাসী হামলায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন তারও রয়েছে লম্বা তালিকা। কেউ কেউ ক্ষত চিহৃ বয়ে বেড়াচ্ছেন দিনের পর দিন। সাংবাদিকদের অনৈক্য সন্ত্রাসীদের সাহসকে উস্কে দিচ্ছে কিনা বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে। সংশ্লিষ্টরা ভেবে দেখবেন কি?
লেখক : সাংবাদিক।