আব্দাল মিয়া:
শিক্ষক মোদের প্রাণের গুরু
আদর্শের–ই প্রতীক,
তাঁর দেখানো পথে হাঁটে
ছাত্র–ছাত্রী পথিক।
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর শিক্ষক হলেন জাতি গড়ার কারিগর। কিন্তু এ কথাটি আজ যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে বেসরকারি শিক্ষকদের দুঃখভরা জীবন–যাপনের কাছে।
আজ বৈশ্বিক মহামারি কোভিড–১৯ এর ছোবলে গোটা জাতি লণ্ড ভণ্ড। বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর চিকিৎসা বিজ্ঞান গবেষনায় কোভিড–১৯ প্রতিরোধে এখন অবধি ব্যর্থ। মানুষের জ্ঞান–বিজ্ঞান প্রকৃতির কাছে আজ তুচ্ছ। বাংলাদেশে কোভিড–১৯ যখনই আক্রান্ত শুরু হয় তখনই মানব দরদী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার, গার্মেন্টস, গণপরিবহন বন্ধ করার ঘোষণা দেন। সারা দেশে শুরু হয় লকডাউন। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের মাননীয় মন্ত্রী, আইইডিসিআর জনগণকে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করে সচেতন এবং বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এছাড়া আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও কঠোর অবস্থানে আছেন জনগণকে ঘরে রাখতে। তারা দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।ইউরোপ আমেরিকার মতো দেশ অসহায় হয়ে লাশের মিছিল প্রত্যক্ষ করছে। আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া দেশের জন্য কোন পরিণতি অপেক্ষা করছে কে জানে?
আমাদের গ্রাম প্রধান জনবহুল দেশে অজ্ঞতা ও অসচেতনতায় যে কোন দুর্যোগ মহামারিতে ভয়াবহ পরিণতির শিকার হতে হয়। আজ কোভিড–১৯ পরিস্থিতিতে সকল শ্রেণি পেশার মানুষই অসহায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তসহ সকল মানুষের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক! এদের মধ্যে বেসরকারি (ননএমপিও) শিক্ষক–কর্মচারীগণ অনেক বেকায়দায় রয়েছেন। তারা বিনা বেতনে চাকরি করেন। স্বাভাবিক অবস্থায় স্কুল–কলেজের বাইরে অফটাইমে তারা এ কাজ সে কাজ করে কোনোমতে সংসার চালান। করোনা পরিস্থিতিতে নিজ গৃহে পরিবার–পরিজনকে নিয়ে শিক্ষক সমাজ আজ কেমন আছেন? কেমন করে দু’বেলা দু’মুঠো আহারের ব্যবস্থা করছেন? এ দুর্যোগে কার কাছে আশ্রয় খুঁজছেন? এ দুঃসময়ে কে–ই বা তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন ? ত্রাণের চাল এবং তেল চুরির হিড়িকের মধ্যে শিক্ষকদের পাশে দাঁড়ানোর সময় কার আছে? মানবতা একেবারে মুছে গেছে–সে কথা আমি বলি না। ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও সাংবাদিকরা মানবতাকে চাঙ্গা করে রেখেছেন। এখন বিশ্ব স্থবির, স্থবির বাংলাদেশ। এ মুহূর্তে পৃথিবীতে কেউ কোথাও ভালো নেই। ভালো নেই জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষকরাও। অনলাইন পত্র–পত্রিকা বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন এলাকার লোকমুখে শুনে সহজেই অনুমেয় শিক্ষক সমাজের অবস্থা।
একজন প্রাইভেট স্কুলের সহকারি শিক্ষক বলেন, খাদ্য সামগ্রী চাল, ডাল, তৈল, লবণ দিয়ে আজ প্রায় তিন মাস হয়ে গেল আলু ভর্তা,শুটকি ভর্তা ও ডাল দিয়ে ভাত খাচ্ছি। এভাবে যে আর কতদিন চলবে একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। পরিবারের চাহিদা পূরণ না করে ব্যয়ের একটা অংশ সঞ্চয় করে যে টাকা জমানো হয়েছিল সেই টাকাও দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিতে অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। বাজারে বিভিন্ন দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আর বাকি দিতে চাচ্ছে না। সব কিছুই বন্ধ থাকায় আমরা বেতনও পাচ্ছিনা।
সরকার করোনা দুর্যোগ কাটিয়ে উঠার জন্য একটি মেগা আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। তালিকাও করা হয়েছে। সেটাও পাইনি। খুব অর্থ সংকটে ভুগছি। আমার স্ত্রীও খুব অসুস্থ। এ অবস্থায় কেউ যদি গোপনে সাহায্য করতো তাহলে উপকার পেতাম। শিক্ষক হিসেবে নিজেকে আজ অনেক লজ্জিত মনে হয়। বেসরকারি শিক্ষক সমাজ আজ কতটা অসহায় হলে এমন কথা মুখে আনে। হাজার হাজার একাডেমি, কোচিং বা প্রাইভেট শিক্ষক টিউশনি করে সংসার চালান, তারা আজ আমার মতো অসহায়।
অপর এক প্রাইভেট স্কুল শিক্ষকের অবস্থাও অত্যন্ত নাজুক। ফেবু্রুয়ারি মাসের পরে থেকে তারা কোন বেতনের মুখ দেখেননি। বাহিরে প্রাইভেট টিউশনি গুলো এখন আর করতে না পারায় এক রকম অভুক্ত অবস্থায় আছে। মধ্যবিত্ত আর যাই করুক কারও কাছে তো সাহায্যের জন্য হাত পাততে পারেনি। তারা ত্রাণ নিবে কিভাবে? পাবেই বা কিভাবে? ত্রাণ বরাদ্ধ তো স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য। বেসরকারি শিক্ষকগণ মনে করেন কোথাও ত্রাণের জন্য হাত পাতার চেয়ে নিরবে–নিভৃতে মরে যাওয়াও অনেক সম্মানের। হতাশার অন্ধকারটি করোনার ঘোর অমানিশায় আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে।
এ রকম চিত্র আজ এই সোনার বাংলার অনেকের ঘরে ঘরে। বেসরকারি শিক্ষক সমাজের কষ্টের কথা কারও কাছে শেয়ার করার মতো নয়। তাই সরকারের কাছে আকুল আবেদন ঔসব অবহেলিত শিক্ষকদের প্রতি সুদৃষ্টি দেওয়ার জন্য। আসুন নিজ নিজ এলাকার বিত্তবানরা যার যার অবস্থান থেকে সামর্থনুযায়ী ঐসব শিক্ষা গুরুদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। যাদের কাছে আমাদের এই সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে মানুষের মতো মানুষ করে প্রতিষ্ঠা করার মূল চাবি কাঠি। যাদের আদর্শে মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠা আমাদের শিশু সন্তানরা। আজ তাদেরই দ্বারে দ্বারে হাত পাততে হচ্ছে। তাদেরকে এই কঠিন বিপদের সময় আমাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে তাদেরকে সমাজে হেয় না করে গোপনে আমাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। তবেই তো বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলা সম্ভব।
লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, তরঙ্গ২৪ডটকম ও ডেসটিনি প্রতিনিধি, বানিয়াচং।