সৈয়দ শামছুল হুদা
শাবান থেকে শাওয়াল কওমী মাদাসার শিক্ষাবর্ষ। রমযান মাস থাকে পুরো ছুটি। গতশিক্ষাবর্ষে কওমী মাদ্রাসার প্রায় ২৮হাজার পরীক্ষার্থী ছিল দাওরায়ে হাদীসে হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়ার। তারা কেহই পরীক্ষা দিতে পারেননি। হয়তোবা এই মাসে কোনভাবে পরীক্ষা নেওয়া হবে। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এই যে ২৮হাজার পরীক্ষার্থী তাদের কর্মসংস্থানের কী হবে? তারা কোথায় যাবে? তাদের কয়জনের সামর্থ আছে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য আরো কয়েকটি বছর সময় দেওয়ার? একদিকে বিপুল সংখ্যক কওমী তরুনের সামনে কর্মসংস্থানের সংকট। অন্য দিকে যারা বিগত দিনে নানা রকম ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে সীমিত আকারে প্রাইভেট মাদ্রাসা গড়ে তুলেছিলেন সেগুলোর অস্তিত্ব নিয়েই এখন টান দিয়েছে।
মার্চ, এপ্রিল ও মে। এই তিন মাস মাদ্রাসা বন্ধ। যারা বিগত ১০/১২বছরে সারা দেশের বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে অসংখ্য মাদ্রাসা গড়ে তুলেছিলেন তাদের সামনে এখন অন্ধকার। তাদের ওপর চেপে বসেছে ৩মাসের বাড়ি ভাড়া। শিক্ষকদের বেতন। এদিকে মাদ্রাসায় ছাত্র নেই। প্রাইভেট মাদ্রাসাগুলোতে সাধারণত দান-সদকা গ্রহন করা হয় না। তারা ছাত্রদের বেতনের ওপরই নির্ভরশীল। এসব মাদ্রাসায় অসংখ্য তরুনের কর্মসংস্থান হয়েছিল। এভাবে যদি আরো কিছুদিন যায়, তাহলে সেই সদ্য কাজে যোগ দেওয়া তরুন আলেমদেরই বা কী অবস্থা হবে? তারা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
দেশের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলোকে এসব নিয়ে মোটেও ভাবতে দেখা যায় না। কোথাও কোন আলোচনা শুনা যায় না যে, তাদের মাদ্রাসা থেকে যারা ফারেগ হচ্ছে তারা কী করবে? কোথায় যাবে? অনেক নবীন আলেম তারা নতুন সংসার গড়েছে। তাদেরই বা কী অবস্থা হবে? কী জবাব দিতে তাদের পিতা-মাতার কাছে? আমাদের মাঝে অনেক আবেগী হযরত রয়েছেন। যারা কোনভাবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। একেকজন অনেকগুলো পদ দখল করে বসে আছেন। মাদ্রাসার মুহতামিম, মসজিদের খতীব, শায়খুল হাদীস, ওয়ায়েজ, বোর্ডের বড় পদ, হাইয়ার বড় পদ, আছে হজ্জ ব্যবসা। নানা দিক দিয়ে আয় আসতে থাকে। উপরুন্ত মাদ্রাসার যারা মুহতামিম তাদের অনেকের পকেটের কোন হিসাব দিতে হয় না। একদিকে আসে। অপরদিকে বের হয়ে যায়। কোথায় যায়? কোন কাজে যায় এসব নিয়ে কারো প্রশ্ন করার কোন ক্ষমতাও নেই। এই সব লোকেরা নতুন ফারেগীনদের কর্মসংস্থানের কথা বললেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। আজকালের আলেমদের মধ্যে কোন তাওয়াক্কুল নাই। আমাদের আকাবিররা কত কষ্ট করেছেন। কত না খেয়ে থেকেছেন এসব ওয়াজ শুনিয়ে দেয়।
কওমী ফারেগীনদেরকে সমাজের আর কোন সেক্টরে প্রবেশের ইচ্ছা থাকে না। তাদেরকে সেভাবে কোন রকম মানসিক প্রস্তুতি অর্জনের সুযোগ দেওয়া হয় না। তাদেরকে এসব সামাজিক কাজে জড়ানোর ব্যাপারে চরমভাবে নিরু’ৎসাহিত করা হয়। এতদিন এই সংকটটা উপলব্দি কম হলেও করোনা পরবর্তী সময়ে এটা প্রকট আকার ধারণ করবে। অনেক কওমী আলেমের কর্মসংস্থান থাকবে না। পুরাতন মাদ্রাসায় যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। কারণ সেখানে হয়তো ৮/১০মাসের বেতন বাকী। মুহতামিম সাহেব চাইবেন নতুন কাউকে নিয়ে শুন্যস্থান পূরণ করতে। যাকে কম বেতনে খাটানো যাবে।
আমি খুব আতঙ্কিত প্রাইভেট মাদ্রাসাগুলোকে নিয়ে। বর্তমানে প্রাইভেট মাদ্রাসাগুলো নিয়ে নানা কথা হলেও তাদের লেখাপড়ার মান খারাপ না। অনেক বড় বড় মাদ্রাসায় মুহতামিমদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে, যোগ্য শিক্ষকদের তাড়িয়ে সাহেবজাদা, বা তোষামোদী লোকদের দ্বারা প্রতিষ্ঠান ভরে ফেলার কারণে সেখানের লেখাপড়ার মান একেবারেই নীচে নেমে গেছে। অথচ মাদ্রাসার বয়স ৫০বছর বা ষাট বছর। অনেক আয়। কিন্তু সেই পরিমান ভালো মানের উস্তাদ নেই। লেখাপড়া নেই। একেকজন্ শিক্ষকের পেটভরা অহঙ্কার। বড় মাদ্রাসার বড় মুহাদ্দিস। ঠিক মতো কারো দিকে ফিরে তাকাবার সময়ও নেই। উনারা উনাদেরই এখান থেকে ফারেগ হওয়া ছাত্রদের নিয়ে তেমন কিছুই ভাবেন না। উপরুন্ত যদি ওখানেরই ফারেগ কোন ছাত্র পাশেই কোন মাদ্রাসা করে, তাহলে তাকে দিলি দুশমন মনে করা হয়। তাকে কীভাবে দুর্ব ল করা যাবে, কীভাবে তার আয়-ইনকাম বন্ধ করে দেওয়া যাবে তার চেষ্টা করেন।
অবশ্য এবার বড় মাদ্রাসাগুলোও আর্থিক সংকটে পড়বে। কারণ তারা যেসব পয়সাওয়ালাদের নিকট থেকে রমযানে মোটা অংকের অর্থ কালেকশান করতেন সেটা এবার সম্ভব হবে না। বিদেশ থেকেও মোটা অংকের সাহায্য আসবে বলে মনে হয় না। এদিকে দিকে নবীন আলেমদের হাতে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলো কিছুটা সুবিধাই গ্রহন করবে। কারণ তারা নিজেদেরকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি রেখেছেন।
সম্মানিত পাঠক! আসুন, কওমী তরুনদের কর্মসংস্থান নিয়ে ভাবি। তাদেরকে দেশের সকল সেক্টরে কীভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তার জন্য পরিকল্পনা তৈরী করি। সার্বিক সহযোগিতা করি নবীন আলেমদের। মিষ্টি মিষ্টি কথায় কাজ হবে না। তাদেরকে কাজ দিতে হবে। তাদের আয়ের পথ করে দিতে হবে।
নবীন আলেমদের প্রতি আহবান, দেশে সরকারী চাকুরী ছাড়াও হাজার পদের চাকুরী আছে, ব্যবসা আছে। যেথায় যেভাবে ঢুকে যাওয়া যায় তার চেষ্টা করতে থাকুন। নিজেদেরকে নিজেদের আদর্শের ওপর অবিচল রাখুন। পাশাপাশি কাজ খুঁজতে থাকুন। নিজের হাতে আয় করার জন্য আশে-পাশের বন্ধুদের সাথে মতবিনিময় করুন। যৌথভাবেও কোন ব্যবসা করা যায় কী না সেটা নিয়েও ভাবুন। কোন কাজকেই ছোট মনে করবেন না। হালাল পথে যে কোন ব্যবসা শুরু করুন। আস্তে আস্তে দেখবেন নিজেরাই পথ করে নিতে পেরেছেন।
আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসাগুলোর প্রতি বিশেষভাবে রহম করেন। নবীন ও প্রবীন বেকার আলেমদেরকে যথাযোগ্য, মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেন। যে সকল তরুন আলেম গত ১০/১২ বছরে অসংখ্য প্রাইভেট মাদ্রাসা গড়ে তুলেছেন সেগুলোকে স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে পারেন তার জন্য দুআ করছি।
করোনা ভাইরাস থেকে উদ্ভুত সংকট মোকাবেলায় আমাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করতে হবে। একে অপরকে সহযোগিতা করার মানসিকতা তৈরী করতে হবে। আমরা যৌথ কোন কাজে অভ্যস্থ না। বিশেষকরে ব্যবসায়িক কৌশল সম্পর্কে আমাদের ধারণা একেবারেই কম। এসব বিষয়ে যারা অভিজ্ঞ, তাদের নিকট থেকে আমরা পরামর্শ গ্রহন করতে পারি।
জেনারেল সেক্রেটারী
বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট বিআইএম