তরঙ্গ ডেস্ক : বর্তমানে জামায়াতে কোনো রাষ্ট্রদ্রোহী ও যুদ্ধাপরাধী নেই * করোনা, বন্যা ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলার সক্ষমতা সরকারের নেই
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেছেন, ঐক্যফ্রন্ট দ্বারা বিএনপি চরমভাবে প্রতারিত হয়েছে। জোটটি গঠিত হয়েছিল মূলত বিএনপিকে নির্বাচনে নেয়ার জন্য। বিএনপিকে একটা শাস্তি দেয়ার জন্য।
তিনি বলেন, বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীতে কোনো রাষ্ট্রদ্রোহী ও যুদ্ধাপরাধী নেই। জামায়াতও জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলে।
সাবেক এ মন্ত্রী বলেন, দেশে করোনা, বন্যা এবং অর্থনৈতিক সংকট- এ তিন সমস্যা মোকাবেলা করার সক্ষমতা সরকারের নেই। হয়তো এক সময় স্ব-ইচ্ছায় সরকার পদত্যাগ করে সরে দাঁড়াবে।
রাজধানী মহাখালীর ডিওএইচএসের নিজ বাসায় যুগান্তরকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. অলি আহমেদ এসব কথা বলেন। এ সময় করোনা পরিস্থিতি, সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা, দুর্নীতি, ২০ দলীয় জোট সক্রিয় কিনা, জামায়াতে ইসলামীকে জোটে রাখা না রাখা, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে না যাওয়া, জাতীয় মুক্তিমঞ্চ গঠনকে কেন্দ্র করে বিএনপির সঙ্গে দূরত্বসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন তিনি। কর্নেল (অব.) অলি আহমদ জাতীয় মুক্তিমঞ্চের আহ্বায়কও।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে এলডিপি কেন যায়নি এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. অলি আহমদ বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে নেয়ায় জন্য আমার ঘরেও এসেছিলেন, ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন। উনি আমাকে অনুরোধ করেছিলেন যে, ড. কামাল হোসেন হবেন এক নম্বরে, দুই নম্বরে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং আমার অবস্থান হবে। আমরা উভয়ে সেকেন্ড ম্যান হিসেবে কাজ করব। তখন উনাকে অনুরোধ করেছিলাম এ জোটে আমি যাব না। কারণ ড. কামাল হোসেন খুবই ভালো ও ভদ্রলোক, পৃথিবীর একজন প্রসিদ্ধ আইনজীবী। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি খুব একটা সফলতা দেখাতে পারেননি। সুতরাং তার নেতৃত্বে যে সফলতা আসবে এটা আমি বিশ্বাস করি না। পরে জনগণ দেখেছেন কোনো মিটিংয়ে ড. কামাল হোসেন জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার কথা বলেননি। বঙ্গবন্ধুর কথা বলেছেন, জয়বাংলা দিয়ে শুরু করেছেন আবার জয়বাংলা দিয়ে শেষ করেছেন। আমার মনে হয়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছিল বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য এবং বিএনপিকে একটা শাস্তি দেয়ার জন্য। যা পরে হয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট দ্বারা বিএনপি চরমভাবে প্রতারিত হয়েছে।
২০ দলীয় জোট সক্রিয় আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাচনের পরে আমি ২০ দলের কোনো বৈঠকে যাইনি। দুটি বৈঠক হয়েছে। খালেদা জিয়া না থাকলে আমি কার নেতৃত্বে গিয়ে বৈঠকে বসব। আর আমার অবস্থানও স্পষ্ট নয়। নির্বাচনের আগে আমাকে কখনও বলা হয়েছে আমি জোটের প্রধান সমন্বয়কারী। তার পরের বৈঠকে সমন্বয়ক, পরের বৈঠকে মুখপাত্র। তারপর কোনো পাত্রেই নাই। আমি বলব না জোট সক্রিয় আছে।
জোট থেকে জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দেয়ার কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে সাবেক এ মন্ত্রী বলেন, জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেবে কিনা এ নিয়ে ২০ দলের কোনো বৈঠকে আলোচনা হয়নি। আমার বক্তব্য হল, বিএনপির দুর্দিনে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে চার দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়েছিল। ওই সময়ে জামায়াতের মধ্যে অনেক যুদ্ধাপরাধী ছিল। যার কারণে আমি বাধা দিয়েছিলাম। তারপরও তারা চারদলীয় জোটে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিল। বর্তমানে জামায়াতে কোনো রাষ্ট্রদ্রোহী নেই, যুদ্ধাপরাধী নেই। তারাও জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বর্তমান জামায়াতের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
২০ দলের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে অনৈক্যের কথা শোনা যাচ্ছে, আপনার জাতীয় মুক্তিমঞ্চ গঠনকে কেন্দ্র করেও কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা কল্পনাপ্রসূত। ২০ দল থাকা অবস্থায় বিএনপি এককভাবে ড. কামালের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট করেছে। সুতরাং আমরাও অনুরূপভাবে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সরকারের ব্যর্থতা জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য জাতীয় মুক্তিমঞ্চ করে বিএনপির হাতকে শক্তিশালী করেছি। তবে এত নেতা যখন একসঙ্গে হন, তাদের মধ্যে নানা মত এবং মতপার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক।
করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে এলডিপির সভাপতি বলেন, করোনা বিস্তার রোধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল। যেমন প্রথম সপ্তাহে কারফিউ বা ইমার্জেন্সি দিয়ে সবাইকে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া। বিদেশ থেকে যারা এসেছেন তাদের কড়াকড়িভাবে কোয়ারেন্টিনে রাখা উচিত ছিল। এতে করে সংক্রমণ সম্পূর্ণভাবে রোধ হতো। সরকারের কারণে জনগণ ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হয়েছিল। কিন্তু থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের অনুরূপ ইমার্জেন্সি বা কারফিউ দিয়ে করোনা সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। জানি না কি কারণে সরকার এত ভীত ছিল। কেন ইমার্জেন্সি বা কারফিউও দিল না। অন্যদিকে জনগণকে অবাধে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার জন্য লম্বা ছুটি দিয়ে যাতায়াতের সুবিধা করে দিল। বিদেশ থেকে আসা লোকদের কোয়ারেন্টিনে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল, তাদের পরীক্ষারও ব্যবস্থা ছিল না। সরকারের এ কর্মকাণ্ডের ফলে সমগ্র দেশে করোনা বিস্তার লাভ করেছে এবং জনগন প্রতিদিন সংক্রমিত হচ্ছে। সরকার বর্তমানে মৃত্যুর যে হিসাব দিচ্ছে, তার সঙ্গেও বাস্তবতার কোনো মিল নেই। কারণ অনেকে সামাজিক ভয়ে করোনা হয়েছে তা প্রকাশ করছেন না।
দেশের দুর্নীতি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে সাবেক এ মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, প্রতিটি মন্ত্রণালয় দুর্নীতির শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী এবং তাদের অধীনে অধিকাংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারী দলীয় আনুগত্য দেখানোর মাধ্যমে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছে। কয়েক হাজার রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভিন্ন পন্থায় মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে জনগণের টাকা পাচার করেছে। পাপিয়া-সম্রাট ও সাহেদের মতো হাজার হাজার ব্যক্তি এ সরকারের মধ্যে লুকিয়ে আছে। এছাড়াও বিগত ১২ বছরে প্রতিটি উপজেলায় ও পৌরসভায় শত শত মাদকসেবী, অবৈধ অস্ত্রবাজ ও সন্ত্রাসী তৈরি হয়েছে। তাদের জীবনমান ও বাড়িঘর ভিন্ন ধরনের। এরা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
এখন পর্যন্ত দেশে বড় কোনো দুর্নীতিবাজের শাস্তি হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, উচিত ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাদের ফাঁসির ব্যবস্থা করা। দোয়া-দুরুদ পড়তে হয় আল্লাহর আনুগত্যের জন্য, বেহেশতে যাওয়ার জন্য, কিন্তু সরকার চালানোর জন্য নয়। সরকার চালানোর কাজে উচ্চপর্যায়ে যারা অবস্থান করছেন তাদের মধ্যে সততা না থাকলে অধীনস্থদের মধ্যে সততা আসবে না।
সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ড. অলি আহমদ বলেন, দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করতে হবে। প্রকাশ্যে তাদের বিচার করে দ্রুত সময়ের মধ্যে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের সব ধরনের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে, পাসপোর্ট নিয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য নতুনভাবে আইন করতে হবে। বাংলাদেশে মন্ত্রীরা যদি সৎ হন, ৬৪ ডিসি ও এসপি, সব টিএনও, ওসি এবং ৬৪ জেলার জেলা ও দায়রা জজ মোট এক হাজারের অধিক হবেন না- এরা যদি সৎ হন তাহলে দেশে কখনও দুর্নীতি হবে না।
এ মহামারীতে রাজনৈতিক দলগুলোকে অসহায় মানুষের পাশে সেভাবে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে না কেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে এলডিপি সভাপতি বলেন, জনগণের পাশে দাঁড়ায়নি এটা ঠিক নয়। আমি নিজেও আমার নির্বাচনী এলাকায় প্রায় ৬ হাজার প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী দলমত, ধর্ম নির্বিশেষে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করেছি। অনুরূপভাবে আমার এলাকার উপজেলা ও পৌরসভার নেতারাও তাদের নিজ উদ্যোগে ও সাধ্যমতো খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছেন। আমার জানা মতে, সারা দেশে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা এ ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। সরকারের জন্য এটা যেমন সহজ, কিন্তু বিরোধী দলগুলোর জন্য তা সহজ নয়।
বর্তমান সংকট মোকাবেলা করার মতো সরকারের কোনো সক্ষমতা নেই বলে মনে করেন এলডিপি সভাপতি। তিনি বলেন, সরকারকে ৩টি সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে। করোনা, বন্যা এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক অর্থনৈতিক সংকট। এ ৩টি সংকট একই সময়ে উপস্থিত হয়েছে। হয়তো এক সময় স্ব-ইচ্ছায় সরকার পদত্যাগ করে সরে দাঁড়াবে।
সূত্র : দৈনিক যুগান্তর