অপূর্ব শর্মা :
‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম, আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম, গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান, মিলিয়া বাউলাগান আর মুর্শিদি গাইতাম।’সত্যিই আগে আমরা সুন্দর দিন কাটিয়েছি। রাজনৈতিক বিভাজনে সৃষ্ট ঘটনাগুলো বাদ দিলে দেখা যাবে, বাঙালির হাজার বছরের যে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সেটা সম্প্রীতির, সৌহার্দ্যরে, পরমত সহিষ্ণুতার। শুধু শাহ আবদুল করিমের গানেই আমরা মানবতার জয়গান শুনতে পাইনা তারও অনেক অনেক আগে কবি চন্ডীদাস আমাদের শুনিয়েছেন মানব-ইতিহাসের মানবিক বাণী, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ এইযে বানী সেটাতো মানুষেরই জয়গান। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ গুছাতেই এমন উচ্চারণ করেছিলেন চন্ডীদাস। কিন্তু আমরা যতই আধুনিক হচ্ছি, ততই যেনো পানসে হয়ে যাচ্ছে আমাদের সম্পর্কগুলো। বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার এই সময়ে দাঁড়িয়েও আমরা সর্বত্র প্রত্যক্ষ করছি বিভেদ আর বিভাজন। পরিবার থেকে শুরু করে, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং রাষ্ট্র সর্বত্রই যেনো অবিশ্বাসের বাতাবরণ। হৃদ্যতা, আন্তরিকতা, শ্রদ্ধাবোধ, ভ্রাতৃত্ব¡বোধের অভাব প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। সামাজিক স্তম্ভগুলো ক্রমশ যেমন দূর্বল থেকে দূর্বলতর হচ্ছে তেমনই শিষ্টাচারের অভাব এবং মানবিক মূল্যবোধ ম্রিয়মান হতে থাকায় ঘনীভূত হচ্ছে সঙ্কট। সেটা আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্যেকেই শুধু হুমকির মুখে ফেলছে না, সামাজিক নিরাপত্তার জন্যও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে, কেন বাড়ছে মানুষের মধ্যে হিংস্রতা, তুচ্ছ ঘটনায় ঘটছে প্রাণ সংহারের মতো ঘটনা? আসলে, সম্পর্কের টানাপোড়ন থেকে রেশারেশি এবং তা থেকে মতভেদ এবং শেষমেশ সেই বিভাজনই সৃষ্টি করছে বিরূপ পরিবেশ, যা উন্মত্ত করে তুলছে মানুষকে। সেটা আমাদের চিরকালীন সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে করছে বিনষ্ট।
ঠিক কোন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে আমাদের সম্পর্কগুলো? কোনদিকে যাচ্ছি আমরা? এই অবনতিশীল সম্পর্কের সূত্রপাত কোত্থেকে? এই বিষয়গুলো স্বভাবতই ভাবায়। তবে কেনও এমনটি হচ্ছে এর কারণ খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। সাদামাটাভাবেই আমরা বলে দিতে পারি, পরিবারই এর সূতিকাগার! কারণ পারিবারিক শিক্ষাই মানুষের চলার পথের পাথেয়। শৈশবে পরিবার থেকে যে শিক্ষা গ্রহণ করে সেটাই মানুষ প্রয়োগ করে প্রাত্যহিকতায়। তবে, এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয়। মন্দ পরিবেশে বড় হয়ে যেমন অগনন ভালো মানুষ আছে সমাজে, তেমনই ভালো পরিবেশে বেড়ে উঠে খারাপ হয়েছে এমন উদাহরণ দেওয়া যাবে অসংখ্য। সাফল্যের অমোঘ ঘোড়ার পেছনে ছুটে প্রতিষ্ঠা পেতে চাওয়াও আমাদের নৈতিকতার স্খলন ঘটানোর পেছনে কাজ করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঠিক এমন পর্যায়ে পৌছেছে আমাদের সম্পর্কগুলো সেটা ভাবলে মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। এক্ষেত্রে আমার এক ঘনিষ্ট সংবাদকর্মীর উদাহরণ দিতে চাই। তাকে বিমর্ষ থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম কি কারনে তিনি মনমরা হয়ে আছেন? তিনি জানালেন, পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন। আমি ভালো করার কি কোনও চেষ্টা চালাবো বলার পর তিনি যেটা বললেন, সেটা শুনে চমকে উঠেছি। অভাবের কারণে তাঁকে ঘরছাড়া হতে হয়েছে। এখানেই শেষ নয় কাহিনী, মেয়েকে মানুষ করার পর সে চাকুরি করছে, আর ছেলের লেখাপড়ার খরচও তিনি নির্বাহ করছেন। অথচ পরিবারে থাকার সুযোগ নেই তাঁর। মাঝখানে মধ্যস্থতা হয়েছিলো, সেটা একটি রুমের ভাড়া দেবার বদৌলতে ঐ রুমে থাকবেন তিনি। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সঙ্গীনী এবং আত্মজা মিলে ঘরছাড়া করেছে তাঁকে। ট্রাই করে দেখি বলার পর বললেন, আমার মেয়ে আমার কাছেই খারাপ থাকুক, আপনার কাছে সে খারাপ হোক সেটা আমি চাইনা। তাঁর দু’চোখ তখন ছলছল করছিলো।
বাবা পড়ালেখার খরচ দিচ্ছেন ছেলের আর মেয়ের রোজগারে চলছে পরিবার, অথচ গৃহকর্তাই ঘরছাড়া। অন্য কোনও কারণে নয় স্রেফ অভাবের কারণে। স্বভাবতই অনেক প্রশ্ন ভীড় করে মনে। তখনই মনে পড়ে যায় পিতা-মাতা হন্তারক ঐশির কথা। নিজের অজান্তেই আতকে উঠি। যে কিনা সুখ সাচ্ছন্দে থাকার পরও মা বাবাকে হত্যার মতো ঘৃণ্য অপরাধ করেছিল। এটা ঐ ঘটনার ঠিক বিপরীত হলেও মিল আছে একটি জায়গায়; সেটি সম্পর্কের অবনতি। যা থেকে জন্ম হচ্ছে ব্যভিচারের। যা সমাজকে করছে দুষিত! এই দুটি ঘটনায় আমরা যেমন মূল্যবোধের সঙ্কট উপলব্ধি করি তেমনই মানবিক অবক্ষয়ের চিত্রও প্রত্যক্ষ করি। আর এই সঙ্কটই সামাজিক সমস্যা তৈরিতে ভূমিকা রাখছে।
মা-বাবার মধ্যে মতবিরোধ, ঝগড়া বিবাদ প্রত্যক্ষ করতে করতে অনেক সময় সেই সন্তান মানসিকভাবে বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়ে। এদের কেউ কেউ আসক্ত হচ্ছে মাদকে। সেই আসক্তি যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে তখন এর ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বাধ্য হয়েই সে অনৈতিকভাবে অর্থ রোজগারে পথে পা বাড়ায়। জড়িয়ে পড়ে অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। এতে করে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেমন অবনতি হচ্ছে তেমনই সমাজিক নিরাপত্তা পড়ছে হুমকির মুখে। আর সম্পর্কগুলো হয়ে উঠছে অনুভূতিহীন। আদরের সন্তানকে তখন চিনতে পারেন না মা বাবা!
আরেকটি কারণেও তিক্ত হচ্ছে আমাদের সম্পর্কগুলো। সেটি হচ্ছে সামাজিক ভারসাম্যহীনতা। ভেদাভেদ যখন প্রকট হয়, বৈষম্য যখন দৃষ্টি এড়ায়না তখন বেষ্টনীতে ঘুণ পোকার আবাস গড়ে উঠে। সেই পোকাই একদিন সবকিছু খেয়ে ‘জড়ো জড়’ করে। তাই প্রথমে ব্যক্তি তারপর পরিবার এবং সর্বশেষ সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়নে মনোনিবেশ করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন, প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় ঘরে ঢুকে স্কুল ছাত্রীকে হত্যার ঘটনাগুলো আমাদেরকে সে কথাই স্মরণ করাচ্ছে? সেই সঙ্গে দাঁড় করাচ্ছে বিশাল এক প্রশ্নের মুখোমুখি। কোথায় যাচ্ছি আমরা? আমাদের এই যাত্রার শেষ কোথায়? স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর যেখানে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে এ কোন পথে চলেছি, চলছে আমাদের সন্তানেরা ? স্বভাবতই তখন পারিবারিক শিক্ষার বিষয়টি এসে যায়, সন্তানকে যদি মানুষের মত মানুুষ করা হতো তাহলে সে সকল সম্পর্ককেই শ্রদ্ধা করতো, তখন অমানুষের মতো আচরণ করতে পারতো না অন্যের সঙ্গে! প্রাণ সংহার করাতো দূরের কথা। তাই সম্পর্কের উন্নয়নে পরিবারকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। তবে, সেটা শুরু করতে হবে শৈশব থেকে।
সকল ক্ষেত্রেই সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে, ভালোবাসায়, মায়ায়, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতিতে। তাহলে মসৃণ হবে আমাদের আগামীর পথে যাত্রা। হৃদ্যতার পথ ধরেই আসবে সমৃদ্ধি। অন্যথায় পিছনের দিকে যেতে যেতে এমন জায়গায় পৌছুবো যেখান থেকে আর পেছানোর কোন জায়গা থাকবেন। তাই আসুন সিদ্ধান্ত নিই সকল বিরোধপূর্ণ সম্পর্ককে ভালো করার। কারন এছাড়া সুস্থ সমাজ বিনির্মানের আর কোনও পন্থা নেই। আর সুস্থ সমাজ বিনির্মান করা সম্ভব না হলে সমৃদ্ধ দেশ গঠনও সম্ভব নয়।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক দৈনিক যুগভেরি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক
সংবাদ শিরোনাম ::
এগিয়ে যেতে হবে আলোর পথে
-
তরঙ্গ ২৪ ডেস্ক :
- আপডেট সময় ০১:১৬:১১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুন ২০২০
- ১৩০ বার পড়া হয়েছে
ট্যাগস
জনপ্রিয় সংবাদ