মোঃ হাফিজুর রহমান চৌধুরী : শোয়াইব আহমেদ খান। তার বাবার নাম ছিল জনাব মাওলানা আলী আহমদ খান। তিনি বানিয়াচং সিনিয়র ফাযিল (আলিয়া) মাদরাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন এবং একজন দক্ষ আলেম ছিলেন। আর আমি মোঃ হাফিজুর রহমান চৌধুরী। আমার বাবার নাম জনাব আলহাজ্ব জানমামুদ চৌধুরী। তিনি প্রায় দীর্ঘ ৪০ বৎসর যাবৎ মাহতাবপুর গ্রামের জামে মসজিদের মুতাওয়াল্লী ছিলেন এবং মাহতাবপুর সরকারি প্রাইমারি স্কুলের অনেক বৎসর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। মাহতাবপুর গ্রামের বিভিন্ন গ্রাম্য বিচার সভার সভাপতিত্ব করতেন।
শোয়াইব আহমেদ খান এবং আমি এই মাহতাবপুর গ্রামের সন্তান। সম্ভবত এক বৎসর আমরা দুইজন মাহতাবপুর প্রাইমারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে একসাথে পড়েছি। শোয়েব তার বাবার চাকরির সুবাদে বিভিন্ন যায়গায় লেখাপড়া করেছেন। বয়সে আমি তার থেকে কিছু বড়। তারপরও তিনি আমাকেই এক নম্বর বাল্য বন্ধু হিসেবে সিলেক্ট করেছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার পরও একদিন বলেছিলেন, হাফিজ! চাকরির সুবাদে অনেক অফিসারের সাথে পরিচিত হচ্ছি। কিন্তু একান্ত মনের কথা সবার সাথে বলা যায় না। তোমার সাথেই একান্ত মনের কথা বলা যায়। কাজে তুমিই আমার এক নম্বর বন্ধু থাকবে। আর আমি মনে করি আছেও।
পঞ্চম শ্রেণি পাস করে আমি ভর্তি হলাম হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। শোয়েব অন্যত্র ভর্তি হলো। কিন্তু গ্রামে যখন যেতাম এক সাথে আড্ডা দিতাম। শোয়েব আমাদের গ্রামের বাড়িতে প্রায়ই আসত, আমি, আমার শ্রদ্বেয় আব্বা, আমার চাচাত্ববড় ভাই জনাব মুসলিম চৌধুরী ইত্যাদি একত্রে বসে আড্ডা দিতাম। তার পর শোয়েব এসএসসি পাস করল, আমি এসএসসি পাস করলাম। তিনি এসএসসিতে প্রথম বিভাগ পেলেন, আমি প্রথম বিভাগ পেলাম। তিনি এইসএসতি খুব ভালো ফলাফল করলেন, কিন্তু আমি এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করতে পারলামনা না, কারণ এইসএসসি পরীক্ষার সময় আমার জীবনে একটি বিশেষ দুর্ঘটনা হয়েছিল। তারপর মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু মানউন্নয়ন পরীক্ষার প্রায় একমাস ছয়দিন আগে আর একটি বিশেষ দুর্ঘটনা হয়েছিল । এর ফলে অনার্স পড়াও আমার ভাগ্যে জোটে নাই। সিলেটে এমসি কলেজ থেকে পাস কোর্সে গ্রাজুয়েশন করলাম। শোয়েব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হলো। কিন্তু তারপরও আমাদের বন্ধুত্ত্বের ঘাটতি হয় নাই। আমি বিএ পাস করে তখনকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) মাস্টার্সে ভর্তি হলাম। শোয়েব তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। আমরা প্রায় ছয়মাস একসাথে ছিলাম।

শোয়েব অনার্স–মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রশাসন থেকে পাস করলেন এবং ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ হলেন। আমি মাস্টার্স প্রথম পর্ব পাস করে ১৯৯১ সালে বানিয়াচং সিনিয়র ফাযিল মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলাম। চাকরিরত অবস্থায় মাস্টার্স ফাইনাল দিয়েছিলাম। কিন্তু ফলাফল ভালো করতে পারি নাই। এরপরও শোয়েব এবং আমার মধ্যে সম্পর্কের ঘাটতি হয় নাই। আমি সিনিয়র শিক্ষক হলাম। আর শোয়েব ম্যাজিস্ট্রেট থেকে এসিল্যান্ড হলো, ইউএনও হলো, এডিসি হলো, উপসচিব হলো। বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ম সচিব এবং বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে ডাইরেক্টর হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব এখনও অটুট আছে। ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার পরও আমার বানিয়াচং আদমখানির বাসায় একা একা ১/২ বার এসেছেন, আমার শ্বশুর বাড়িতেও গেছেন। একদিন স্বপরিবারে বেড়িয়েছেন এবং আর একদিন বাচ্চাদের নিয়ে বেড়িয়ে গেছেন। তারপর মধ্যে মধ্যে আমরা একে অন্যের খোঁজ খবর নেই। তিনি আমাদের গ্রামের অন্যান্যদের খোঁজ–খবর নেন।
উপসংহারে আমি এই কথাই বলতে চাই, শোয়েব এতবড় একজন কর্মকর্তা হয়েও আমি একজন শিক্ষকের সাথে বন্ধুত্ব অটুট রাখছেন। আশা করি বাকি জীবনও আমাদের সম্পর্ক ঠিকই থাকবে ইনশাআল্লাহ। এভাবেই মানুষ মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখা উচিত। যে কোনো আপদ–বিপদে কাজে লাগতে পারে।
পরিশেষে মানুষে মানুষে সম্পর্ক অটুট থাকুক এই কামনা করে এবং সবাই সুস্থ থাকেন, নিরাপদে থাকেন মহান আল্লাহর কাছে এই দোয়া রেখে, আমার এ লেখা এখানেই শেষ করছি।
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, বানিয়াচং সিনিয়র ফাযিল (আলিয়া) মাদরাসা।