ঢাকা ০৫:৩৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
Logo সাংবাদিক মঈন উদ্দিন এঁর পিতার মৃত্যুতে তরঙ্গ২৪.কম পরিবার গভীরভাবে শোকাহত Logo গ্যানিংগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে নানা আয়োজনে মহান বিজয় দিবস উদযাপন Logo মহান বিজয় দিবসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে বানিয়াচং মডেল প্রেসক্লাব Logo দেশবাসীকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ‘বানিয়াচং ইসলামি নাগরিক ফোরাম’ নেতৃবৃন্দ Logo নূরানী শিক্ষা বোর্ডে মেধা তালিকায় ২য় হয়েছে গ্যানিংগঞ্জ বাজার নূরানী মাদ্রাসার ছাত্রী মুনতাহা আক্তার Logo বানিয়াচংয়ে ১২কেজি গাঁজাসহ কুখ্যাত ৩ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার Logo বানিয়াচং শাহজালাল কে.জি স্কুল ২০২৩ বৃত্তি পরীক্ষায় ঈর্ষণীয় সাফল্য Logo চেয়ারম্যান মোঃ আনোয়ার হোসেন ডা. ইলিয়াছ একাডেমির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচিত Logo ৪০তম তাফসিরুল কোরআন মহা সম্মেলন সফল করায় আলহাজ্ব রেজাউল মোহিত খানের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ Logo ইফার সাবেক ফিল্ড অফিসার আব্দুল ওয়াদুদের মৃত্যুতে জেলা মউশিক কল্যাণ পরিষদ নেতৃবৃন্দের শোক

ইতিহাসের আয়নায় ‘সাহেবজাদা’ সমাচার

  • তরঙ্গ ২৪ ডেস্ক :
  • আপডেট সময় ০৬:৫৫:৪৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ অগাস্ট ২০২০
  • ১৭১ বার পড়া হয়েছে

আহমদ বদরুদ্দীন খান : দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ তথ্যটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, মুসলমানদের বিগত দেড় হাজার বছরের সোনালী ইতিহাসের কপালে যে কয়টি কলঙ্কের দাগ দেখতে পাওয়া যায়, তার প্রায় সব কয়টির জন্যই দায়ী হচ্ছে কোন খলিফাজাদা বা বাদশাহ্জাদা অথবা নবাবজাদা কিংবা সাহেবজাদা। অঘটন পটিয়সী এই জাদাদের দুষ্কর্মের কারণেই ইসলামের গৌরবোজ্জল স্বর্ণালী ইতিহাস যুগে যুগে কলঙ্কিত হয়েছে।

ইতিহাসের চড়াই উৎরাই পার হয়ে উল্লেখিত অনেক জাদারাই আজ বিলুপ্ত, তবে বাদশাহ্জাদা ও সাহেবজাদাগণের অস্তিত্ব আজও মুসলিম বিশ্বে সমানতালে বিদ্যমান। সেই সাথে তাদের না না অপকর্মের দরুন সমগ্র উম্মতে মুসলিমা আজ নানান দিক থেকে বিপর্যস্ত। যেমন, মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় পরিচালিত মুসলিম দেশগুলোর দিকে তাকালে আমীর তথা বাদশাহ্জাদাদের না না অপকর্মের খতিয়ান দেখতে পাওয়া যায়।

ঠিক তেমনি পাক ভারত উপমহাদেশের দিকে তাকালে আমরা সাহেবজাদাগণের দ্বারা সৃষ্ট না না ফেৎনা-ফাসাদের ঘটনা জানতে পারি। যেমন ধরুন, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহের শাহ্জাদাগণ আমেরিকা ও ইজরায়েলের কৃপালাভের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার পূর্বশর্ত হিসেবে নিজ নিজ দেশ থেকে ইসলামকে ঝেটিয়ে বিদায় করে তদস্থলে পশ্চিমা উলঙ্গ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করছে।

এমনিভাবে পাক ভারত উপমহাদেশের অথর্ব সাহেবজাদাগণ এ অঞ্চলের বিভিন্ন দ্বীনী মারকায ও আন্দোলনে না না ফেৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে সেগুলোর স্বাভাবিক গতিধারা ব্যাহত করছে। যেমন ধরুন, অতি সম্প্রতি এমনি এক অপরিনামদর্শী সাহেবজাদার হঠকারীতার জন্য বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বিস্তৃত পরিসরে পরিচালিত দ্বীনী দাওয়াতের কার্যক্রম দারুনভাবে ব্যাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

অথচ এই সাহেবজাদার জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, উক্ত দাওয়াতী কার্যক্রমের যে গুরুত্বপূর্ণ পদে তাকে পদায়ন করা হয়েছিল সেই পদের যোগ্য সে কোনকালেই ছিল না। শুধুমাত্র সাহেবজাদা হওয়ার কারণেই একশ্রেণীর আলেম নামধারী তেলবাজ তাকে মহান রাহবার বানিয়ে ঐ গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দিয়েছিল।

অতঃপর সেই সাহেবজাদাই এক সময় যখন নিজের স্বল্প বিদ্যা জনিত ভ্রান্তির কারণে ঐ আলেম সমাজ এমন কি গোটা দাওয়াতী কার্যক্রমের জন্য সবচেয়ে বড় ফেৎনা হিসেবে দেখা দিল, তখন শুধুমাত্র ‘সাহেবজাদা’ এই যোগ্যতা বিবেচনায় নিয়ে পরম ভক্তিভরে যে আলেম সমাজ এক সময় তাকে কাঁধে তুলে নাচানাচি করেছিল।

 

সেই আলেম সমাজই তার এহেন অযোগ্যতার কারণে তাকে কাঁধ থেকে আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। এখন সে যতই চিৎকার চেচামেচি করে বলছে যে, “আমার নাম যেহেতু কান্ধলবী, অতএব -যোগ্যতা থাক চাই না থাক- আমাকে কান্ধে লইতে হবে।

কিন্তু এক সময় যারা তাকে কাঁধে নিয়ে নাচানাচি করেছিল তাদের কেউ কেউ এখন আর তাকে কান্ধে লইতে রাজি হচ্ছে না, তবে এ অঞ্চলের উলামায়ে কেরাম ও সাধারণ মুসলমানদের বড় একটি অংশ এখনও ঐ বিভ্রান্ত সাহেবজাদার এতাআত তথা আনুগত্যের ছায়ায় থেকে দ্বীন প্রচারের নামে না না ফেৎনা-ফাসাদ চালিয়ে যাচ্ছে। আসলে সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের এই উপমহাদেশে অন্ধ-ভক্তি এবং ব্যক্তিপূজা এতটাই বিকট আকার ধারণ করেছে যে, সত্য-মিথ্যা ও ন্যায়-অন্যায়ের উপলব্ধিটুকু পর্যন্ত আমাদের চেতনা থেকে বিলুপ্ত হতে বসেছে।

আহমদ বদরুদ্দীন খান

ইসলামী আকীদা বিশ্বাস মতে হাদী তথা পথ-প্রদর্শক হিসেবে পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্ববিধ যোগ্যতা-সম্পন্ন মানব সম্প্রদায় হচ্ছেন নবী-রাসূলগণ। কেননা, তাঁরা মাসুম এবং স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামীন কর্তৃক মনোনীত। এতদস্বত্ত্বেও জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁদেরকে নানান রকম ঈমানী পরীক্ষা, ঐশী তালিম-তরবিয়ত, কঠোর অনুশীলন ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে দাওয়াত ও রেসালাতের কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছে।

অথচ সেই আম্বিয়ায়ে কেরামের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যে সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে- আমাদের দেশে সেই পীর-মাশায়েখ ও আলেম-উলামাদের অনেকের বেলায় আমরা দেখতে পাই যে, তাঁদের দাওয়াতী কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য পরবর্তী দায়িত্বশীল নির্বাচন করার ক্ষেত্রে সকল প্রকার যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি হচ্ছে ‘সাহেবজাদা’ হওয়া।

অর্থাৎ, -যোগ্যতা থাক চাই না থাক- পীরের সাহেবজাদা পীর, শায়েখের সাহেবজাদা শায়েখ, মুহ্তামিমের সাহেবজাদা মুহ্তামিম, নেতার সাহেবজাদা নেতা হবেন এটাই যেন সকলের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এদেশসহ এই উপমহাদেশের বিগত চার/পাঁচ যুগের ইতিহাসের দিকে তাকালে যৎসামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া এটাই যেন সাহেবজাদাদের ক্ষেত্রে নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। অর্থাৎ, যোগ্যতাহীন তেলতেলে সাহেবজাদাগণ যেন কুচক্রিদের জন্য বহু ত্যাগ-তিতীক্ষার বিনিময়ে নির্মিত ইসলামের গৌরবোজ্জল মিনারগুলো ধ্বংসের প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

আর আমাদের সমাজে এই খারাপ উপসর্গটির উদ্ভব হয়েছে অতি ভক্তি ও মাত্রাতিরিক্ত স্নেহান্ধতার কারণে। কেননা, আমরা অতিভক্তি ও আবেগের তাড়নায় আগ-পিছ বিবেচনা না করেই অনেক অযোগ্য লোককে জাতির অবিসংবাদিত রাহ্বার কিংবা সেরে তাজ বানিয়ে দেই। একবারও ভেবে দেখি না যে, ঐ ব্যক্তির মধ্যে আদৌ সেই সালাহিয়্যাত তথা নেতৃত্ব দেয়ার মত যোগ্যতা কিংবা দৃঢ়তা আছে কি না।

অর্থাৎ, ব্যক্তিগত রাগ-বিরাগ ও স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে তিনি ক্রান্তিকালে জাতিকে সঠিক পথ দেখাতে সক্ষম কি না। একটি আদর্শ জাতির উপযুক্ত নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে আমরা মোটেই পাত্তা দেই না। বরং আমাদের বিবেচনায় থাকে ব্যক্তি-বিশেষের ক্ষেত্রে সাহেবে-নিসবত-জনিত অতি আবেগ ও অতি ভক্তি।

অতঃপর সালাহিয়্যাত না থাকার ফলে যখন বিপর্যয় দেখা দেয়, তখনও আমরা অতিভক্তি ও আবেগের উপর দাঁড়িয়ে সেই ব্যর্থ নেতৃত্বকে মিনমিনে গলায় নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্যায়ভাবে সমর্থন যুগিয়ে যাই। পাছে বেয়াদবী হয়ে যায় কি না- এই ভেবে উপযুক্ত সময়ে হক কথা বলা থেকেও কেউ কেউ বিরত থাকি। এমন কি সেই ধ্বসে পড়া নড়বড়ে নেতৃত্বকে নিজেদের মতলবে দাঁড় করিয়ে রাখতে অযোগ্য-অথর্ব সাহেবজাদাদের দিয়ে ঠেক দেয়ারও অপচেষ্টা করা হয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মুসলিম উম্মাহর বিপর্যয়ের সূচনাই হয়েছিল এই সাহেবজাদা-প্রসূত স্নেহান্ধতা থেকে। বিস্তর অযোগ্যতা স্বত্ত্বেও শুধুমাত্র সাহেবজাদা হওয়ার সুবাদে ইয়াযিদ যখন শাসকরূপে উম্মাহর কাঁধে চেপে বসল, তখন থেকেই বিপর্যয়ের সূচনা হলো।

কতিপয় এক চোখা ঐতিহাসিক আবেগ-তাড়িত হয়ে অনেক কিছুকে আড়াল করতঃ ইয়াযিদকে যোগ্যতার মানদন্ডে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করে থাকেন, কিন্তু জীবন-চরিত সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বিশ্লেষকদের নির্মোহ বিচারে শুধুমাত্র স্নেহান্ধ সাহেবজাদা হওয়া ছাড়া তৎকালীন দুনিয়ায় মুসলিম উম্মাহর ন্যায় সর্বশ্রেষ্ঠ সম্প্রদায়ের উপযুক্ত শাসক হওয়ার মত চারিত্রিক দৃঢ়তা, যোগ্যতা ও দূরদর্শিতা ইয়াযিদের মধ্যে ছিল না।

কারণ, যদি সে যোগ্যতা তার থাকতো তবে সহস্রাধিক যোগ্য সাহাবায়ে কেরামদের বাদ দিয়ে এবং তাঁদেরকে নিজের প্রতিপক্ষ বানিয়ে- সাহাবী নয় এমন স্বার্থান্বেষী অযোগ্যদের দিয়ে প্রশাসনিক পূণর্বিন্যাস সে করত না। তাছাড়া মুসলিম উম্মাহর মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়ার মত কারবালার ন্যায় হৃদয়-বিদারক শোকাবহ ঘটনাও তার শাসনামলে তারই নেতৃত্বে সংঘটিত হতো না।

অথচ এর বিপরীতে খোলাফায়ে রাশেদীন- যাঁদের প্রত্যেকেরই নেতৃত্ব দেয়ার মত হুনর-হেকমত সম্পন্ন যোগ্য সন্তান থাকা স্বত্ত্বেও তাঁরা স্ব স্ব শাসনামলে সন্তানদের অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ক্ষমতার দায়েরা থেকে দূরে রেখেছেন। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা.), হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.), হযরত আবান ইবনে ওসমান (রা.), হযরত হাসান ইবনে আলী (রা.) ও হযরত হোসাইন ইবনে আলী (রা.)-এর ভূমিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, খোলাফায়ে রাশেদীন তথা ইসলামের খলিফা চতুষ্টয়ের স্ব স্ব শাসনামলে তাঁদের শাসনতান্ত্রিক দৃঢ়তা ও স্বচ্ছতার কারণে তাঁদের সন্তানগণ যথেষ্ট যোগ্যতা-সম্পন্ন হওয়া স্বত্ত্বেও অতি সাধারণ প্রজা সাধারণের ন্যায় জীবন-যাপন করেছেন।

অতঃপর বনু উমাইয়া যুগে এসে সেই দৃঢ়তা ও স্বচ্ছতার অভাবে স্নেহান্ধ শাসক পিতৃকূলের অযোগ্য-অথর্ব সাহেবজাদাগণের স্বেচ্ছাচারিতায় মুসলিম শাসনামলের ইতিহাসে কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়। এরপর বিভিন্ন যুগে ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় পৈত্রিক মৌরুসীর বদৌলতে অযোগ্য সাহেবজাদাদের হাতে শাসন-ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়ার ফলে উম্মাহর জীবনে না না বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। মোটকথা, দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বিগত দেড় হাজার বছরে ইসলামের ইতিহাসে শাসকবৃন্দের স্নেহান্ধ মৌরুসী সাহেবজাদাদের দ্বারা উম্মতে মুসলিমা নানান ভাবে নিগৃহীত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আর ইতিহাসের কলঙ্কিত সাহেবজাদা ইয়াযীদের পিছনে যেমন একদল মুসলিম-বিদ্বেষী ও স্বার্থান্ধ খারেজী বরকন্দাজ সক্রিয় ছিল। ঠিক তেমনি পরবর্তী সময়েও তোষামোদ-প্রিয় সাহেবজাদাদের পিছনে একদল তেলবাজ মতলবী লোক সর্বদা সক্রিয় থেকেছে। আর এখনও সে ধারা মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র সমানভাবে অব্যাহত আছে।

অথচ আমরা ভালো করেই জানি যে, ইসলামে নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্ব কোন ওয়ারিস কিংবা সাহেবজাদা হওয়া বা শায়েখ কর্তৃক প্রদত্ব খেলাফত ও এজাযতের মানদন্ডে নির্ধারিত হওয়ার বিষয় নয়। বরং ইলম ও তাক্বওয়ার মানদন্ডে উপযুক্ত আহলে শুরা কর্তৃক নির্ধারিত হওয়ার বিষয়। এর অন্যথা হলে উম্মাহর জীবনে বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠে।

আর আমরা যদি আমাদের সময়কালের দিকেও তাকাই তাহলেও দেখতে পাই যে, আমাদের এই ভুখন্ডে যে সকল কালজয়ী মনীষীগণ মুসলিম উম্মাহর অবিসংবাদিত নেতৃত্বের আসনে শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র হিসেবে দূর কিংবা নিকট অতীতে বরিত হয়েছেন সেই সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ্ (রাহ্.), হযরত মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (রাহ্.), হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রাহ্.), হযরত মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ্ হাফেজ্জী হুজুর (রাহ্.), ফখরে বাঙ্গাল হযরত মাওলানা তাজুল ইসলাম (রাহ্.), হযরত মাওলানা আমিমুল এহ্সান মুজাদ্দেদী (রাহ্.), খতীবে আযম হযরত মাওলানা সিদ্দীক আহমদ (রাহ্.) হযরত মাওলানা আত্হার আলী (রাহ্.), হযরত মাওলানা আবদুল করীম শায়খে কৌড়িয়া (রাহ্.), হযরত মাওলানা উবায়দুল হক (রাহ্.), হযরত মাওলানা সিরাজুল ইসলাম বড় হুজুর (রাহ্.), শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আজিজুল হক (রাহ্.), হযরত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রাহ্.), হযরত মাওলানা ফজলুল হক আমিনী (রাহ্.), হযরত মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী (রাহ্.), হযরত মাওলানা নুরউদ্দীন গহরপুরী (রাহ্.), হযরত শায়খে কাতিয়া (রাহ্.) হযরত মাওলানা মুফতী আবদুর রহমান (রাহ্.) এমন কি বর্তমান সময়ে উম্মাহর নেতৃত্ব দানকারী শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা আহমদ শফী (দা. বা.), হযরত মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী (দা. বা.), হযরত আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (দা. বা.) হযরত মুফতী আবদুস সালাম চাটগামী (দা. বা.), হযরত মুফতী আবদুল মালেক (দা. বা.), হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান (দা. বা.) হযরত মাওলানা সুলতান যওক নদভী (দা. বা.) এঁদের একজনও শৈশব কিংবা কৈশোরে তথাকথিত সাহেবজাদা ছিলেন না।

বরং তাঁরা এই সমাজের অতি সাধারণ ধর্মভীরু পিতা-মাতার আত্মমর্যাদাশীল অধ্যাবসায়ী মেধাবী সন্তান ছিলেন। শিক্ষা জীবনে বা যৌবন কালে কেউ তাঁদের ‘সাহেবজাদা’ বলে তেল মারেনি। বরং জীবনের প্রতিটি ধাপে তাঁরা কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবেলা করে সর্বোচ্চ অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে নিজেদেরকে আজকের গৌরবোজ্জল অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

পক্ষান্তরে আমরা যারা তাঁদের সাহেবজাদা হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেই- সেই সাহেবজাদাদের একজনও কি তাঁদের সম-উচ্চতায় নিজেদের জীবনকে উন্নীত করতে পেরেছি? কিংবা পেরেছি কি তাঁদের চর্চিত আদর্শের উপর নিজেদের প্রতিষ্ঠিত রাখতে? বরং ক্ষেত্র বিশেষে আমাদের কেউ কেউ এমন সব কর্মকা- করে যাচ্ছি, যা তাঁদের মহান পিতৃবর্গের অর্জিত সম্মানকে ভুলুণ্ঠিত করছে।

“আর তাই আমরা আমাদের পিতা মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রাহ্.)-এর সান্নিধ্যে থাকাকালীন কোন সাক্ষাৎপ্রার্থী যখন এসে আমাদের দেখিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করতেন, হুযুর! ইনি কি আপনার সাহেবজাদা? তখন আমার বাবা বেশ বিরক্তি নিয়ে প্রশ্নকর্তাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করতেন, আপনার ধারণায় আমার ছেলে সাহেবজাদা- আর আমি কি হারামজাদা? প্রশ্নকর্তা তখন কিছু বুঝতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বাবার মূখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।

বাবা নিজের বিরক্তিভাব কিছুটা দূর হওয়ার পর বলতেন, দেখুন! এসব তেলমারা পরিভাষা ত্যাগ করুন। কারণ, আমাদের সন্তানরা যদি একবার এটা ভেবে বসে যে, আমরা তো সাহেবজাদা হয়ে গেছি, তাহলে তাদের বরবাদি আর কোনভাবেই ঠেকানো যাবে না। অতএব সর্বনাশের হাতিয়ার ‘সাহেবজাদা’র তকমা লাগিয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবন-বোধ বরবাদ করবেন না। কেননা, চারিদিকে তেলতেলে সাহেবজাদাদের যে প্রদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে, তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে উম্মাহর জীবনে এই সাহেবজাদাদের দ্বারা সৃষ্ট না না ফেৎনা-ফাসাদের পূর্বাভাস আমি সুস্পষ্টরূপে দেখতে পাচ্ছি।”

অতএব না না ঘটনা প্রবাহের আলোকে আমার বাবার সেই আশংকার বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দ্বীনী অঙ্গনে কেমন যেন দিন দিন সুস্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে। এগুলো কিসের আলামত? ধ্বংসের, না পরিবর্তনের- তা একমাত্র রাব্বুল আলামীনই ভালো বলতে পারবেন।

সবশেষে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিনয়ের সাথে নিবেদন করতে চাই যে, দুনিয়াব্যাপী করোনা-সৃষ্ট এই নযীর-বিহীন সংকটকালে বিশ্বের সর্বত্র উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদার মুসলমানগণ মানব সেবায় যে অসাধারণ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন, তা আজ বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে আলোচিত ও প্রশংসনীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

আর সেই অবদানকে বাংলাদেশের কওমী অঙ্গনের তরুণ আলেম সমাজ নিজেদের জীবনের ঝুকি নিয়ে আরো বহুগুণে মহিমান্বিত করে তুলেছেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আর্তের সেবায় তাঁদের এই অতুলনীয়, অবিস্মরণীয় অবদান সরকারী-বেসরকারী সংস্থাসহ দেশের সর্বশ্রেণীর বিবেকবান মানুষের ভূয়শী প্রশংসায় সিক্ত হচ্ছে।

অতএব ইতিহাসের গতিধারা পরিবর্তনকারী এই নাযুক সময়ে আলেম নামক হাতে গোনা গুটি কয়েক স্বার্থান্বেষী পদলোভী আবুল ফযলদের অপতৎপরতায় আমাদের অহংকারের প্রতীক ত্যাগী আলেম সমাজের সেই অবিস্মরণীয় অবদান যেন ম্লান হয়ে না যায়- সেই বিষয়টির প্রতি আমাদের অভিভাবক-তুল্য উলামায়ে কেরামগণ সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। আমীন।

লেখক : সম্পাদক, মাসিক মদীনা, ঢাকা।
সৌজন্যে : কওমীকণ্ঠ

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

সাংবাদিক মঈন উদ্দিন এঁর পিতার মৃত্যুতে তরঙ্গ২৪.কম পরিবার গভীরভাবে শোকাহত

ইতিহাসের আয়নায় ‘সাহেবজাদা’ সমাচার

আপডেট সময় ০৬:৫৫:৪৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ অগাস্ট ২০২০

আহমদ বদরুদ্দীন খান : দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ তথ্যটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, মুসলমানদের বিগত দেড় হাজার বছরের সোনালী ইতিহাসের কপালে যে কয়টি কলঙ্কের দাগ দেখতে পাওয়া যায়, তার প্রায় সব কয়টির জন্যই দায়ী হচ্ছে কোন খলিফাজাদা বা বাদশাহ্জাদা অথবা নবাবজাদা কিংবা সাহেবজাদা। অঘটন পটিয়সী এই জাদাদের দুষ্কর্মের কারণেই ইসলামের গৌরবোজ্জল স্বর্ণালী ইতিহাস যুগে যুগে কলঙ্কিত হয়েছে।

ইতিহাসের চড়াই উৎরাই পার হয়ে উল্লেখিত অনেক জাদারাই আজ বিলুপ্ত, তবে বাদশাহ্জাদা ও সাহেবজাদাগণের অস্তিত্ব আজও মুসলিম বিশ্বে সমানতালে বিদ্যমান। সেই সাথে তাদের না না অপকর্মের দরুন সমগ্র উম্মতে মুসলিমা আজ নানান দিক থেকে বিপর্যস্ত। যেমন, মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় পরিচালিত মুসলিম দেশগুলোর দিকে তাকালে আমীর তথা বাদশাহ্জাদাদের না না অপকর্মের খতিয়ান দেখতে পাওয়া যায়।

ঠিক তেমনি পাক ভারত উপমহাদেশের দিকে তাকালে আমরা সাহেবজাদাগণের দ্বারা সৃষ্ট না না ফেৎনা-ফাসাদের ঘটনা জানতে পারি। যেমন ধরুন, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহের শাহ্জাদাগণ আমেরিকা ও ইজরায়েলের কৃপালাভের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার পূর্বশর্ত হিসেবে নিজ নিজ দেশ থেকে ইসলামকে ঝেটিয়ে বিদায় করে তদস্থলে পশ্চিমা উলঙ্গ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করছে।

এমনিভাবে পাক ভারত উপমহাদেশের অথর্ব সাহেবজাদাগণ এ অঞ্চলের বিভিন্ন দ্বীনী মারকায ও আন্দোলনে না না ফেৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে সেগুলোর স্বাভাবিক গতিধারা ব্যাহত করছে। যেমন ধরুন, অতি সম্প্রতি এমনি এক অপরিনামদর্শী সাহেবজাদার হঠকারীতার জন্য বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বিস্তৃত পরিসরে পরিচালিত দ্বীনী দাওয়াতের কার্যক্রম দারুনভাবে ব্যাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

অথচ এই সাহেবজাদার জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, উক্ত দাওয়াতী কার্যক্রমের যে গুরুত্বপূর্ণ পদে তাকে পদায়ন করা হয়েছিল সেই পদের যোগ্য সে কোনকালেই ছিল না। শুধুমাত্র সাহেবজাদা হওয়ার কারণেই একশ্রেণীর আলেম নামধারী তেলবাজ তাকে মহান রাহবার বানিয়ে ঐ গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দিয়েছিল।

অতঃপর সেই সাহেবজাদাই এক সময় যখন নিজের স্বল্প বিদ্যা জনিত ভ্রান্তির কারণে ঐ আলেম সমাজ এমন কি গোটা দাওয়াতী কার্যক্রমের জন্য সবচেয়ে বড় ফেৎনা হিসেবে দেখা দিল, তখন শুধুমাত্র ‘সাহেবজাদা’ এই যোগ্যতা বিবেচনায় নিয়ে পরম ভক্তিভরে যে আলেম সমাজ এক সময় তাকে কাঁধে তুলে নাচানাচি করেছিল।

 

সেই আলেম সমাজই তার এহেন অযোগ্যতার কারণে তাকে কাঁধ থেকে আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। এখন সে যতই চিৎকার চেচামেচি করে বলছে যে, “আমার নাম যেহেতু কান্ধলবী, অতএব -যোগ্যতা থাক চাই না থাক- আমাকে কান্ধে লইতে হবে।

কিন্তু এক সময় যারা তাকে কাঁধে নিয়ে নাচানাচি করেছিল তাদের কেউ কেউ এখন আর তাকে কান্ধে লইতে রাজি হচ্ছে না, তবে এ অঞ্চলের উলামায়ে কেরাম ও সাধারণ মুসলমানদের বড় একটি অংশ এখনও ঐ বিভ্রান্ত সাহেবজাদার এতাআত তথা আনুগত্যের ছায়ায় থেকে দ্বীন প্রচারের নামে না না ফেৎনা-ফাসাদ চালিয়ে যাচ্ছে। আসলে সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের এই উপমহাদেশে অন্ধ-ভক্তি এবং ব্যক্তিপূজা এতটাই বিকট আকার ধারণ করেছে যে, সত্য-মিথ্যা ও ন্যায়-অন্যায়ের উপলব্ধিটুকু পর্যন্ত আমাদের চেতনা থেকে বিলুপ্ত হতে বসেছে।

আহমদ বদরুদ্দীন খান

ইসলামী আকীদা বিশ্বাস মতে হাদী তথা পথ-প্রদর্শক হিসেবে পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্ববিধ যোগ্যতা-সম্পন্ন মানব সম্প্রদায় হচ্ছেন নবী-রাসূলগণ। কেননা, তাঁরা মাসুম এবং স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামীন কর্তৃক মনোনীত। এতদস্বত্ত্বেও জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁদেরকে নানান রকম ঈমানী পরীক্ষা, ঐশী তালিম-তরবিয়ত, কঠোর অনুশীলন ও অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে দাওয়াত ও রেসালাতের কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছে।

অথচ সেই আম্বিয়ায়ে কেরামের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যে সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে- আমাদের দেশে সেই পীর-মাশায়েখ ও আলেম-উলামাদের অনেকের বেলায় আমরা দেখতে পাই যে, তাঁদের দাওয়াতী কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য পরবর্তী দায়িত্বশীল নির্বাচন করার ক্ষেত্রে সকল প্রকার যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি হচ্ছে ‘সাহেবজাদা’ হওয়া।

অর্থাৎ, -যোগ্যতা থাক চাই না থাক- পীরের সাহেবজাদা পীর, শায়েখের সাহেবজাদা শায়েখ, মুহ্তামিমের সাহেবজাদা মুহ্তামিম, নেতার সাহেবজাদা নেতা হবেন এটাই যেন সকলের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এদেশসহ এই উপমহাদেশের বিগত চার/পাঁচ যুগের ইতিহাসের দিকে তাকালে যৎসামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া এটাই যেন সাহেবজাদাদের ক্ষেত্রে নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। অর্থাৎ, যোগ্যতাহীন তেলতেলে সাহেবজাদাগণ যেন কুচক্রিদের জন্য বহু ত্যাগ-তিতীক্ষার বিনিময়ে নির্মিত ইসলামের গৌরবোজ্জল মিনারগুলো ধ্বংসের প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

আর আমাদের সমাজে এই খারাপ উপসর্গটির উদ্ভব হয়েছে অতি ভক্তি ও মাত্রাতিরিক্ত স্নেহান্ধতার কারণে। কেননা, আমরা অতিভক্তি ও আবেগের তাড়নায় আগ-পিছ বিবেচনা না করেই অনেক অযোগ্য লোককে জাতির অবিসংবাদিত রাহ্বার কিংবা সেরে তাজ বানিয়ে দেই। একবারও ভেবে দেখি না যে, ঐ ব্যক্তির মধ্যে আদৌ সেই সালাহিয়্যাত তথা নেতৃত্ব দেয়ার মত যোগ্যতা কিংবা দৃঢ়তা আছে কি না।

অর্থাৎ, ব্যক্তিগত রাগ-বিরাগ ও স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে তিনি ক্রান্তিকালে জাতিকে সঠিক পথ দেখাতে সক্ষম কি না। একটি আদর্শ জাতির উপযুক্ত নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে আমরা মোটেই পাত্তা দেই না। বরং আমাদের বিবেচনায় থাকে ব্যক্তি-বিশেষের ক্ষেত্রে সাহেবে-নিসবত-জনিত অতি আবেগ ও অতি ভক্তি।

অতঃপর সালাহিয়্যাত না থাকার ফলে যখন বিপর্যয় দেখা দেয়, তখনও আমরা অতিভক্তি ও আবেগের উপর দাঁড়িয়ে সেই ব্যর্থ নেতৃত্বকে মিনমিনে গলায় নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্যায়ভাবে সমর্থন যুগিয়ে যাই। পাছে বেয়াদবী হয়ে যায় কি না- এই ভেবে উপযুক্ত সময়ে হক কথা বলা থেকেও কেউ কেউ বিরত থাকি। এমন কি সেই ধ্বসে পড়া নড়বড়ে নেতৃত্বকে নিজেদের মতলবে দাঁড় করিয়ে রাখতে অযোগ্য-অথর্ব সাহেবজাদাদের দিয়ে ঠেক দেয়ারও অপচেষ্টা করা হয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মুসলিম উম্মাহর বিপর্যয়ের সূচনাই হয়েছিল এই সাহেবজাদা-প্রসূত স্নেহান্ধতা থেকে। বিস্তর অযোগ্যতা স্বত্ত্বেও শুধুমাত্র সাহেবজাদা হওয়ার সুবাদে ইয়াযিদ যখন শাসকরূপে উম্মাহর কাঁধে চেপে বসল, তখন থেকেই বিপর্যয়ের সূচনা হলো।

কতিপয় এক চোখা ঐতিহাসিক আবেগ-তাড়িত হয়ে অনেক কিছুকে আড়াল করতঃ ইয়াযিদকে যোগ্যতার মানদন্ডে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করে থাকেন, কিন্তু জীবন-চরিত সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বিশ্লেষকদের নির্মোহ বিচারে শুধুমাত্র স্নেহান্ধ সাহেবজাদা হওয়া ছাড়া তৎকালীন দুনিয়ায় মুসলিম উম্মাহর ন্যায় সর্বশ্রেষ্ঠ সম্প্রদায়ের উপযুক্ত শাসক হওয়ার মত চারিত্রিক দৃঢ়তা, যোগ্যতা ও দূরদর্শিতা ইয়াযিদের মধ্যে ছিল না।

কারণ, যদি সে যোগ্যতা তার থাকতো তবে সহস্রাধিক যোগ্য সাহাবায়ে কেরামদের বাদ দিয়ে এবং তাঁদেরকে নিজের প্রতিপক্ষ বানিয়ে- সাহাবী নয় এমন স্বার্থান্বেষী অযোগ্যদের দিয়ে প্রশাসনিক পূণর্বিন্যাস সে করত না। তাছাড়া মুসলিম উম্মাহর মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়ার মত কারবালার ন্যায় হৃদয়-বিদারক শোকাবহ ঘটনাও তার শাসনামলে তারই নেতৃত্বে সংঘটিত হতো না।

অথচ এর বিপরীতে খোলাফায়ে রাশেদীন- যাঁদের প্রত্যেকেরই নেতৃত্ব দেয়ার মত হুনর-হেকমত সম্পন্ন যোগ্য সন্তান থাকা স্বত্ত্বেও তাঁরা স্ব স্ব শাসনামলে সন্তানদের অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ক্ষমতার দায়েরা থেকে দূরে রেখেছেন। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা.), হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.), হযরত আবান ইবনে ওসমান (রা.), হযরত হাসান ইবনে আলী (রা.) ও হযরত হোসাইন ইবনে আলী (রা.)-এর ভূমিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, খোলাফায়ে রাশেদীন তথা ইসলামের খলিফা চতুষ্টয়ের স্ব স্ব শাসনামলে তাঁদের শাসনতান্ত্রিক দৃঢ়তা ও স্বচ্ছতার কারণে তাঁদের সন্তানগণ যথেষ্ট যোগ্যতা-সম্পন্ন হওয়া স্বত্ত্বেও অতি সাধারণ প্রজা সাধারণের ন্যায় জীবন-যাপন করেছেন।

অতঃপর বনু উমাইয়া যুগে এসে সেই দৃঢ়তা ও স্বচ্ছতার অভাবে স্নেহান্ধ শাসক পিতৃকূলের অযোগ্য-অথর্ব সাহেবজাদাগণের স্বেচ্ছাচারিতায় মুসলিম শাসনামলের ইতিহাসে কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়। এরপর বিভিন্ন যুগে ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় পৈত্রিক মৌরুসীর বদৌলতে অযোগ্য সাহেবজাদাদের হাতে শাসন-ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়ার ফলে উম্মাহর জীবনে না না বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। মোটকথা, দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বিগত দেড় হাজার বছরে ইসলামের ইতিহাসে শাসকবৃন্দের স্নেহান্ধ মৌরুসী সাহেবজাদাদের দ্বারা উম্মতে মুসলিমা নানান ভাবে নিগৃহীত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আর ইতিহাসের কলঙ্কিত সাহেবজাদা ইয়াযীদের পিছনে যেমন একদল মুসলিম-বিদ্বেষী ও স্বার্থান্ধ খারেজী বরকন্দাজ সক্রিয় ছিল। ঠিক তেমনি পরবর্তী সময়েও তোষামোদ-প্রিয় সাহেবজাদাদের পিছনে একদল তেলবাজ মতলবী লোক সর্বদা সক্রিয় থেকেছে। আর এখনও সে ধারা মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র সমানভাবে অব্যাহত আছে।

অথচ আমরা ভালো করেই জানি যে, ইসলামে নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্ব কোন ওয়ারিস কিংবা সাহেবজাদা হওয়া বা শায়েখ কর্তৃক প্রদত্ব খেলাফত ও এজাযতের মানদন্ডে নির্ধারিত হওয়ার বিষয় নয়। বরং ইলম ও তাক্বওয়ার মানদন্ডে উপযুক্ত আহলে শুরা কর্তৃক নির্ধারিত হওয়ার বিষয়। এর অন্যথা হলে উম্মাহর জীবনে বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠে।

আর আমরা যদি আমাদের সময়কালের দিকেও তাকাই তাহলেও দেখতে পাই যে, আমাদের এই ভুখন্ডে যে সকল কালজয়ী মনীষীগণ মুসলিম উম্মাহর অবিসংবাদিত নেতৃত্বের আসনে শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র হিসেবে দূর কিংবা নিকট অতীতে বরিত হয়েছেন সেই সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ্ (রাহ্.), হযরত মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (রাহ্.), হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রাহ্.), হযরত মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ্ হাফেজ্জী হুজুর (রাহ্.), ফখরে বাঙ্গাল হযরত মাওলানা তাজুল ইসলাম (রাহ্.), হযরত মাওলানা আমিমুল এহ্সান মুজাদ্দেদী (রাহ্.), খতীবে আযম হযরত মাওলানা সিদ্দীক আহমদ (রাহ্.) হযরত মাওলানা আত্হার আলী (রাহ্.), হযরত মাওলানা আবদুল করীম শায়খে কৌড়িয়া (রাহ্.), হযরত মাওলানা উবায়দুল হক (রাহ্.), হযরত মাওলানা সিরাজুল ইসলাম বড় হুজুর (রাহ্.), শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা আজিজুল হক (রাহ্.), হযরত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রাহ্.), হযরত মাওলানা ফজলুল হক আমিনী (রাহ্.), হযরত মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী (রাহ্.), হযরত মাওলানা নুরউদ্দীন গহরপুরী (রাহ্.), হযরত শায়খে কাতিয়া (রাহ্.) হযরত মাওলানা মুফতী আবদুর রহমান (রাহ্.) এমন কি বর্তমান সময়ে উম্মাহর নেতৃত্ব দানকারী শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা আহমদ শফী (দা. বা.), হযরত মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী (দা. বা.), হযরত আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (দা. বা.) হযরত মুফতী আবদুস সালাম চাটগামী (দা. বা.), হযরত মুফতী আবদুল মালেক (দা. বা.), হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান (দা. বা.) হযরত মাওলানা সুলতান যওক নদভী (দা. বা.) এঁদের একজনও শৈশব কিংবা কৈশোরে তথাকথিত সাহেবজাদা ছিলেন না।

বরং তাঁরা এই সমাজের অতি সাধারণ ধর্মভীরু পিতা-মাতার আত্মমর্যাদাশীল অধ্যাবসায়ী মেধাবী সন্তান ছিলেন। শিক্ষা জীবনে বা যৌবন কালে কেউ তাঁদের ‘সাহেবজাদা’ বলে তেল মারেনি। বরং জীবনের প্রতিটি ধাপে তাঁরা কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবেলা করে সর্বোচ্চ অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে নিজেদেরকে আজকের গৌরবোজ্জল অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

পক্ষান্তরে আমরা যারা তাঁদের সাহেবজাদা হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেই- সেই সাহেবজাদাদের একজনও কি তাঁদের সম-উচ্চতায় নিজেদের জীবনকে উন্নীত করতে পেরেছি? কিংবা পেরেছি কি তাঁদের চর্চিত আদর্শের উপর নিজেদের প্রতিষ্ঠিত রাখতে? বরং ক্ষেত্র বিশেষে আমাদের কেউ কেউ এমন সব কর্মকা- করে যাচ্ছি, যা তাঁদের মহান পিতৃবর্গের অর্জিত সম্মানকে ভুলুণ্ঠিত করছে।

“আর তাই আমরা আমাদের পিতা মাওলানা মহিউদ্দীন খান (রাহ্.)-এর সান্নিধ্যে থাকাকালীন কোন সাক্ষাৎপ্রার্থী যখন এসে আমাদের দেখিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করতেন, হুযুর! ইনি কি আপনার সাহেবজাদা? তখন আমার বাবা বেশ বিরক্তি নিয়ে প্রশ্নকর্তাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করতেন, আপনার ধারণায় আমার ছেলে সাহেবজাদা- আর আমি কি হারামজাদা? প্রশ্নকর্তা তখন কিছু বুঝতে না পেরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বাবার মূখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।

বাবা নিজের বিরক্তিভাব কিছুটা দূর হওয়ার পর বলতেন, দেখুন! এসব তেলমারা পরিভাষা ত্যাগ করুন। কারণ, আমাদের সন্তানরা যদি একবার এটা ভেবে বসে যে, আমরা তো সাহেবজাদা হয়ে গেছি, তাহলে তাদের বরবাদি আর কোনভাবেই ঠেকানো যাবে না। অতএব সর্বনাশের হাতিয়ার ‘সাহেবজাদা’র তকমা লাগিয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবন-বোধ বরবাদ করবেন না। কেননা, চারিদিকে তেলতেলে সাহেবজাদাদের যে প্রদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে, তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে উম্মাহর জীবনে এই সাহেবজাদাদের দ্বারা সৃষ্ট না না ফেৎনা-ফাসাদের পূর্বাভাস আমি সুস্পষ্টরূপে দেখতে পাচ্ছি।”

অতএব না না ঘটনা প্রবাহের আলোকে আমার বাবার সেই আশংকার বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দ্বীনী অঙ্গনে কেমন যেন দিন দিন সুস্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে। এগুলো কিসের আলামত? ধ্বংসের, না পরিবর্তনের- তা একমাত্র রাব্বুল আলামীনই ভালো বলতে পারবেন।

সবশেষে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিনয়ের সাথে নিবেদন করতে চাই যে, দুনিয়াব্যাপী করোনা-সৃষ্ট এই নযীর-বিহীন সংকটকালে বিশ্বের সর্বত্র উলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদার মুসলমানগণ মানব সেবায় যে অসাধারণ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন, তা আজ বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে আলোচিত ও প্রশংসনীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

আর সেই অবদানকে বাংলাদেশের কওমী অঙ্গনের তরুণ আলেম সমাজ নিজেদের জীবনের ঝুকি নিয়ে আরো বহুগুণে মহিমান্বিত করে তুলেছেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আর্তের সেবায় তাঁদের এই অতুলনীয়, অবিস্মরণীয় অবদান সরকারী-বেসরকারী সংস্থাসহ দেশের সর্বশ্রেণীর বিবেকবান মানুষের ভূয়শী প্রশংসায় সিক্ত হচ্ছে।

অতএব ইতিহাসের গতিধারা পরিবর্তনকারী এই নাযুক সময়ে আলেম নামক হাতে গোনা গুটি কয়েক স্বার্থান্বেষী পদলোভী আবুল ফযলদের অপতৎপরতায় আমাদের অহংকারের প্রতীক ত্যাগী আলেম সমাজের সেই অবিস্মরণীয় অবদান যেন ম্লান হয়ে না যায়- সেই বিষয়টির প্রতি আমাদের অভিভাবক-তুল্য উলামায়ে কেরামগণ সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। আমীন।

লেখক : সম্পাদক, মাসিক মদীনা, ঢাকা।
সৌজন্যে : কওমীকণ্ঠ